রবিবার, ১ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে শিবির-ছাত্রী সংস্থার জঙ্গি আস্তানা

৭৬ গ্রেনেডসহ বিপুল বোমা সরঞ্জাম উদ্ধার

চট্টগ্রামে শিবির-ছাত্রী সংস্থার জঙ্গি আস্তানা

চট্টগ্রাম থেকে গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চট্টগ্রামে এবার জনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকার ভিতর সন্ধান মিলল জঙ্গি আস্তানার। শুক্রবার রাতভর নগরীর হালিশহরের গোল্ডেন কমপ্লেক্স আবাসিক এলাকার একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ হ্যান্ড গ্রেনেড, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার এবং নারীসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিরা হলেন ফয়জুল হক, আবদুল হাই ও রহিমা আকতার। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা বিস্ফোরক ও সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ৭৬টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১ হাজার ২৩৫ পিস বিভিন্ন ধরনের বোমা বানানোর স্টিলের বোতল, ২৪ পিস খালি পাইপ, ৫০ কেজি অ্যালুমিনিয়াম, ৯০০ গ্রাম সোডিয়াম, ৩ কেজি ৮০০ গ্রাম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ২৫০ গ্রাম সালফার, সাড়ে ৬ কেজি নাইট্রেট, ৫০০ গ্রাম ম্যাগনেশিয়াম পাউডার, ১০ কেজি সালফার, ১২ বোরের শটগানের ২৪ রাউন্ড গুলি, ২২ পিস বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক তার, ৫০০ গ্রাম গান পাউডার, ১০ পিস সোডিয়াম। এ ছাড়া আরও প্রায় ২৮ ধরনের ১৫০ কেজি রাসায়নিক সরঞ্জাম, দুই পিস রকেট ফ্লেয়ার, মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, সিরিঞ্জ এবং ১৮৩ জোড়া প্রশিক্ষণজুতাসহ বোমা তৈরির নানা সরঞ্জাম। র‌্যাবের দাবি, উদ্ধার হওয়া বোমা সরঞ্জাম দিয়ে কমপক্ষে দুই হাজার বোমা তৈরি সম্ভব। গ্রেফতার-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘এ জঙ্গি সংগঠনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে। এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে অনেক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ জন্য তাদের আর্থিক সাহায্য, গ্লোবাল রিলেশন প্রয়োজন। এই জঙ্গিদের দেশীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’ তিনি বলেন, হাটহাজারী ও বাঁশখালীতে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের তথ্যের ভিত্তিতে এ আস্তানার সন্ধান মেলে। হাটহাজারী, বাঁশখালী ও হালিশহর থেকে যত-সংখ্যক বোমা, অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে, তা সেনাবাহিনীর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নের ইকুইপমেন্টের সমান। র‌্যাব-৭ অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, উদ্ধার সরঞ্জামের মধ্যে ফ্লাস্ক আকৃতির বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। এ ধরনের একটি বোমা হাতে নিয়ে ঘুরলে মনে হবে বাচ্চাদের স্কুলের ফ্লস্ক। অথচ এটা মারাত্মক প্রাণঘাতী বোমা। জানা যায়, বাঁশখালীর লটমণি পাহাড়ের পাদদেশে পশুপালনের আড়ালে জঙ্গি প্রশিক্ষণের হোতা মাওলানা মোবারকের নেটওয়ার্কের সন্ধান করতে গিয়ে পারভেজের খোঁজ পায় র‌্যাব। কয়েক দিন ধরে তাকে অনুসরণ করার পর হালিশহর আবাসিক এলাকার জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ওই ভবনটি ঘিরে অবস্থান নেয় র‌্যাবের টিম। গভীর রাতে ওখানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ হ্যান্ড গ্রেনেড, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার এবং নারীসহ তিন জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তবে অভিযান চালানোর আগেই এ আস্তানার হোতা পারভেজ পালিয়ে যায়। ওই ভবনের বাসিন্দা সালমা আকতার জানান, গ্রেফতারকৃতরা এক মাস আগে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। দুই দিন আগে একই ফ্ল্যাটে আরও কয়েকজন আসবাবপত্র নিয়ে আসেন। ওই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা প্রতিবেশী কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন না। এমনকি সব সময় দরজা-জানালা বন্ধ রাখতেন। এ জন্য তাদের সম্পর্কে প্রতিবেশীরা তেমন কিছু জানেন না। তাদের সঙ্গে প্রতিবেশীদের পরিচয়ও হয়নি। স্থানীয় যুবক আখতার হোসেন জানান, এক মার্কিন প্রবাসী কয়েক বছর আগে বাড়িটি তৈরি করেন। বাড়ি তৈরির আগে-পরে তিনি কখনো এলাকায় আসেননি। তার শ্যালক সোহাগ বাড়িটির দেখাশোনা করেন। প্রসঙ্গত, ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর আলিপুর মাদ্রাসা থেকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬২ জিবি জঙ্গি প্রশিক্ষণের ভিডিও উদ্ধার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে বাঁশখালীর দুর্গম লটমণি পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।
শিবির-ছাত্রী সংস্থার জঙ্গি আস্থানা : জঙ্গি ও ছাত্রশিবির যৌথভাবে চালাচ্ছে দাওয়াতি কার্যক্রম! চট্টগ্রামের হালিশহরের গোল্ডেন কমপ্লেক্স আবাসিক এলাকার জঙ্গি আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া নথিপত্রে এমন তথ্য মিলেছে। এ কার্যক্রমের তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। অধিকতর তদন্তে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হালিশহর জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া রহিমা আকতার ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া অভিযানে ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থার বেশকিছু নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি নতুন এ জঙ্গি সংগঠন, ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থা যৌথভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছে। জঙ্গি আস্তানা থেকে শিবির ও ছাত্রী সংস্থার নথি উদ্ধারের বিষয় প্রশাসনের জন্য একটা সতর্ক সংকেত।’ জানা যায়, হালিশহর জঙ্গি আস্তানা থেকে বেশকিছু নথিপত্র ও বই উদ্ধার করে র‌্যাব। উদ্ধার হওয়া নথিপত্রের মধ্যে রয়েছে কর্মপরিকল্পনা, ডায়েরি, সাংগঠনিক প্রতিবেদন, শিবিরের রচিত সংবিধান ও সাংগঠনিক দলিল, কয়েকটি প্যাড, মাওলানা সগীর বিন ইমদাদ রচিত ফাযায়েলে জিহাদ নামে একটি প্রকাশনা, জিয়াউর রহমান ফারুকী রচিত ‘যাদের ত্যাগে স্বাধীনতা’ নামে একটি বই, ‘তাওহীদের বর্ষণে শিরকের দংশন’ নামে একটি বই, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ড ও ছাত্রী সংস্থার বেশকিছু প্রচারপত্র। ছাত্রী সংস্থার মহানগর দক্ষিণের সভানেত্রী সুমাইয়া আফরোজার সাংগঠনিক প্রতিবেদনে লেখা রয়েছে- ছাত্রী সংস্থার মহানগর (দক্ষিণ) শাখায় সদস্য আছে ১৯ জন, সদস্যা প্রার্থী আছে ৫ জন, অগ্রসর কর্মী আছে ৬৮ জন, কর্মী ১ হাজার ৭৭ জন এবং সমর্থক ৮ হাজার। মহানগর দক্ষিণে অধ্যয়নরত মোট ছাত্রী প্রায় ১ লাখ। এর মধ্যে আমাদের জনশক্তি ৮ হাজার, শতকরা ৮ ভাগ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ছাত্রী সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভাগভিত্তিক দাওয়াতি কাজ ও জনশক্তি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্বতন্ত্রভাবে চালাচ্ছে। বিভাগগুলো মোট ১১২টি ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। উদ্ধার করা ডায়েরিতে পত্রিকা, অনলাইন গণমাধ্যম, টিভি মিডিয়ার নাম ও মিডিয়াগুলোর কার্যালয়ের ঠিকানাও লেখা আছে। এ ছাড়া যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণ সার্কুলার নামে একটি নথি উদ্ধার করা হয়। ওই নথিতে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কালের কর্মপরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগের নিয়মকানুন উল্লেখ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর