শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মালয়েশিয়ায় চালকের আসনে নারী

মাহাথিরের দেশে ৩

মাহমুদ আজহার, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে

মালয়েশিয়ায় চালকের আসনে নারী

কুয়ালালামপুরে অনেক রেস্টুরেন্টেরই মালিক-শ্রমিক নারী —জয়ীতা রায়

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি শপিং মলে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করেন বাংলাদেশি তরুণী রাহী চৌধুরী। তিন বছর ধরে তিনি ওই শপিং মলে কাজ করছেন। সামাজিক বাধা পেরিয়ে মালয়েশিয়ায় এখন তিনি ‘হ্যান্ডসাম’  সেলারিতে চাকরি করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি জানালেন, ভালোই আছেন। এখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সবাইকে সম্মান করেন। কাজকে সবাই পছন্দ করেন। লামিয়া আবেদীন কাজ করছেন একটি আম্পাং পয়েন্টে বেসরকারি অডিট ফার্মের হিসাবরক্ষক হিসেবে। তিনিও জানালেন, চাকরি এনজয় করছেন। ভালোই আছেন। সবারই সহযোগিতা পাচ্ছেন। নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য নেই। দেশে মা-বাবার সঙ্গেও নিয়মিত কথা হচ্ছে। শুধু এই দুই বাংলাদেশি তরুণীই নন, মালয়েশিয়ান নারীর বড় অংশই দেশটির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ড্রাইভিং সিটে, শপিং মলে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে সর্বত্রই নারীদের বিচরণ। মালয়েশিয়া পুলিশের বৃহৎ একটি অংশই নারী। দেশটির বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন শাখায় দেখা গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কাজ করছেন। এ ছাড়া সমৃদ্ধশালী এ দেশটিতে মালয়েশিয়ান নারীর পাশাপাশি চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা নির্ভয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তবে বাংলাদেশি কতজন নারী সেখানে কাজ করছেন, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কয়েক হাজার বাংলাদেশি নারী মালয়েশিয়ায় কাজ করছেন। এর মধ্যে একটি অংশ ভালো মানের এজেন্টের মাধ্যমে গিয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। সরকারি না হলেও বেসরকারি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। ফাইভ স্টার মানের হোটেলের রিসিপশনেও দেখা মেলে বাংলাদেশের নারীদের। হ্যান্ডসাম সেলারিও পাচ্ছেন তারা। তবে নারীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। কুয়ালালামপুরের আলোচিত-সমালোচিত এলাকা বুকিত বিন্তাংসহ বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশি বেশকিছু মেয়েকে যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অফিসে কাজ দেওয়ার কথা বলে অনেকটা বাধ্য করেই তাদের ওই পথে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের পাসপোর্ট-ভিসা সবকিছুই দালালদের হাতে। এ কারণে অনেকটা অসহায় হয়ে তারা ওই পথে পা বাড়িয়েছেন। এমন দুজন অসহায় তরুণীর সঙ্গে বুকিত বিন্তাং এলাকায় কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ প্রতিবেদকের। তারা কিছু বলতে চাননি আশপাশের দালালদের ভয়ে। পরে আস্থার বিষয়টি জানালে অঝোরে কান্না শুরু করে দেন। তারা জানান, তাদের দেশে ফেরারও কোনো ক্ষমতা নেই। পাসপোর্ট দালালের হাতে। তাদের চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। কারও সঙ্গে সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলতে দেখলে শারীরিক নির্যাতন নেমে আসবে বলেও ওই দুই তরুণী জানান। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নারীদের জন্য একটি চমৎকার কর্মপরিবেশ থাকলেও স্বদেশি দালালরা তা নষ্ট করছে। জানা যায়, মালয়েশিয়ার পুরুষরা খুবই অলস। তারা কাজ করতে চান না। অন্যদিকে নারীরা বেশি শিক্ষিত ও পরিশ্রমী। রাজধানী কুয়ালালামপুর ছাড়াও কোতাবারু, পেনাং, জহুরবারু, ক্যামেরুন হাইল্যান্ড, ইপো পেটালিং জায়া, শাহালমে ঘুরে সর্বত্রই নারীদের পদচারণা লক্ষ্য করা গেছে। রাস্তার পাশের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা পর্যন্ত কর্মস্থলে মালয়ী পুরুষদের চেয়ে নারীদের উপস্থিতিই বেশি চোখে পড়ে। উচ্চশিক্ষায় মালয়ী মেয়েরা ছেলেদের কতটা পেছনে ফেলেছেন, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলেই প্রমাণ মেলে। কুয়ালালামপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মালয়ী নারীদের পোশাকে বিশেষ কোনো ভিন্নতা নেই। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে পর্দার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বাড়াবাড়ি ধরনের কিছু চোখে পড়েনি। মেয়েদের মূল পোশাক বাজু কুরুং। এটিই মালয়ী নারীদের অফিশিয়াল পোশাক। মাথায় বিভিন্ন রঙের স্কার্ফ। হাতে বাহারি চুরি পরতেও দেখা যায় অনেককে। নানান রঙের পাথরের আংটি প্রায় সবার হাতেই। অফিস বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা  রেস্তোরাঁগুলোতে যে মালয়ী নারীদের দেখা মেলে, তাদের পরনে জিন্সের প্যান্ট, টি-শার্ট বা শার্ট আর মাথায় স্কার্ফ। এটাই এখানকার নারীদের সবচেয়ে চোখে পড়া পোশাক। সকালে অফিস টাইমে দেখা যায় বিভিন্ন দিকে ছুটে চলছেন নারীরা। ব্যস্ত প্রাইভেট গাড়িগুলোর চালকের আসনে স্টিয়ারিং হাতে মালয়ীসহ বিভিন্ন দেশের নারী। বাসে নারী চালক আর হেলপারও। সিনেমা হলের টিকিট বিক্রিও করতে দেখা যায় নারীদের।

কুয়ালালামপুরের মারদেকাসহ সব মসজিদেই দেখা মেলে নারীদের। জুমার নামাজে দেখা যায় পুরুষদের চেয়ে নারীদের উপস্থিতি বেশি। মসজিদেও মেয়েদের পোশাক অন্য সময়ের মতোই। তবে মাথায় স্কার্ফ থাকে। সাবিহা সুবাং নামে এক মালয়েশিয়ান নারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আমরা ধর্মটাকে মেনে চলি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। তবে এখানে চাইলেই কেউ ধর্ম নিয়ে মনগড়া এমন কিছু বলতে পারে না। সবাই যার যার ধর্ম মেনে চলেন। জানা যায়, অন্য ধর্মের মেয়েদের পোশাক নিয়ে আপত্তি নেই মালয়েশিয়ান নারীদের। সবাই যার যার মতো করে পোশাক পরছে। চীনা বা থাই মেয়েদের আঁটোসাঁটো হাফপ্যান্ট পরে চলাচল করতেও দেখা গেছে। এ নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই।

সর্বশেষ খবর