মঙ্গলবার, ২২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যায় কোথাও উন্নতি কোথাও অবনতি

রেল যোগাযোগ শুরু

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় কোথাও উন্নতি কোথাও অবনতি

নাটোরের সিংড়ায় পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে বন্যার পানি। গতকাল তোলা ছবি —বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর ও দক্ষিণের ট্রেন চলাচল প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর শুরু হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার পৌলির রেলসেতু পার হয়ে গতকাল বিকাল ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকা থেকে রংপুর যায় ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ ট্রেন। এদিকে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি ও কোথাও অবনতি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদ-নদীর পানি কমে গেলেও কোথাও কোথাও নতুন করে এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবার, চিকিৎসা সহায়তা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বন্যাকবলিত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। বানভাসি এলাকায় বর্তমানে শুরু হয়েছে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। বন্যাকবলিত এলাকায় ডায়রিয়া, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর— রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত : রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রমজান আলী জানান, রবিবার দুপুরে রেলসেতু মেরামত কাজ শুরু হয়। প্রায় ৩০০ শ্রমিক কাজ করে সোমবার বিকালের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত সেতু মেরামত শেষ করে। বন্যার পানিতে পৌলি রেলসেতুর অ্যাপ্রোচের (সংযোগের) প্রায় ২০ ফুট অংশের মাটি রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধসে যায়। ফলে ওই সময় থেকে ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রবিবার উত্তরাঞ্চল থেকে আন্তনগর ট্রেনের মধ্যে একতা, নীলসাগর, চিত্রা, দ্রুতযান ও লোকাল ট্রেন চলাচল করে। এই ট্রেনগুলোর মধ্যে আন্তনগর ট্রেনগুলো বঙ্গবন্ধু সেতু অতিক্রম করে পূর্বপার পর্যন্ত চলাচল করে। সেখানে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসে পূর্বের স্থানের দিকে চলে যায়। সব যাত্রী পূর্বপারে নামার পর বাসযোগে ঢাকায় রওনা হয়।

বগুড়ায় পানি কমছে : বগুড়ায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল যমুনা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে যমুনার পানি কমতে থাকলেও বাড়তে শুরু করেছে বাঙালি নদীর পানি। বাঙালি নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় ৫ উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ১৯৫টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা, শিবগঞ্জ ও নন্দীগ্রাম উপজেলার দেড় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। গতকাল জেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। পানি দ্রুত কমে যাচ্ছে। যমুনায় পানি ১২৬ সেন্টিমিটার থেকে কমে এখন ৩১ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাঙ্গালি নদীর পানি ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এ অঞ্চলে বর্তমানে শুরু হয়েছে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। বন্যাকবলিত এলাকায় পাতলা পায়খানা, জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।

রাজশাহীতে দিশাহারা দেড় লাখ মানুষ : বন্যায় রাজশাহীর দুই উপজেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে এসব মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে। তারা পর্যাপ্ত খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি কিছু সংস্থা তাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শুধু সরকারি হিসাবেই রাজশাহীর বাগমারা ও মোহনপুর উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৬১১টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে, বানভাসি মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৪২ হাজার ৬৮৫ জন।

তবে এরই মধ্যে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ৭০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আমিনুল হক। তিনি জানান, বন্যাকবলিত এলাকার উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চালগুলো বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে জেলার বাগমারা ও মোহনপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বাগমারার আরও একটি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের সঙ্গে উপজেলা ও জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গতকাল সকালে বাগমারার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত শিব নদীর পানির উচ্চতা ১৬ দশমিক ৮৯ মিটার এবং ফকিন্নী নদীর পানি ১৪ দশমিক ৮৯ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে।

বাগমারার যোগীপাড়া ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এদিকে পশ্চিম বাগমারা হয়ে আত্রাই নদীর পানি মোহনপুর উপজেলায় ঢুকছে। তবে মোহনপুরে শিব নদীর ভেঙে যাওয়া বাঁধ এক সপ্তাহ পর মেরামত করতে পেরেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তারপরও রায়ঘাটি ইউনিয়ন দিয়ে আত্রাই নদীর পানি মোহনপুরে ঢুকে পড়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। এই উপজেলার জাহানাবাদ, বাকশিমইল ও মৌগাছি ইউনিয়নের ৮৯টি গ্রামের ৯৭০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

সিরাজগঞ্জে দুর্ভোগে মানুষ : পানি কমতে শুরু করলেও এখনো অধিকাংশ বসতবাড়িতে পানি থাকায় দুর্ভোগ কমেনি। দেখা দিয়েছে খাদ্য-ওষুধ সংকট। সরকারিভাবে পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হলেও অনেক পরিবার তা পায়নি। যেসব পরিবার পেয়েছে তাদেরও শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে বন্যাকবলিতরা। এ ছাড়া ত্রাণ বিতরণে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বজনপ্রীতির অভিযোগও উঠেছে। যমুনার পানি বর্তমানে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অনেকে পানির মধ্যেই বাড়িতে অবস্থান করছে। টয়লেট-বিশুদ্ধ পানির সমস্যায় ভুগছে এসব পরিবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। ওয়াপদা বাঁধে খোকসাবাড়ি ইউনিয়নের খলিশাকুড়া খিচুড়িপাড়া গ্রামের আবদুস সালাম জানান, বাড়িতে এখন প্রায় গলা পানি। ৮ দিন ওয়াপদা বাঁধে রয়েছি। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সাহায্য সহযোগিতা করেনি। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম জানান, ৭১৬ মে.টন চাল ও ১৬ লাখ ৩৫ হাজার নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

নওগাঁয় ত্রাণের জন্য হাহাকার : ঘরে প্রায় কোমর সমান পানি। কেউ কেউ সেখানেই থাকছেন পানি কমার আশায়। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাস্তা কিংবা উঁচু জায়গায়। নৌকা নিয়ে কাছে যেতেই বানভাসি মানুষ ছুটে আসে ত্রাণের আশায়। তারপর যখন শোনেন কেউ তাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে আসেনি, তখন মুখ মলিন হয়ে যায়। বানভাসি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে নারী, শিশু ও পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা। পানির ঢলে নওগাঁর আত্রাই ও ছোট যমুনা নদীর বাঁধ ভেঙে নওগাঁর সদর, মান্দা, রানীনগর, আত্রাই, বদলগাছি, পত্নীতলা, মহাদেবপুর, ধামইরহাট ও সাপাহার, পোরশা উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নের প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। মান্দা উপজেলার বিষ্ণপুর ইউনিয়নে আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে গবাদিপশু সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। নৌকা নিয়ে সেখানে যেতেই ১০-১২ জন মানুষ ছুটে এসে ত্রাণের জন্য নিজেদের নাম লিখতে বলেন। তারপর সাংবাদিক পরিচয় শুনে সবার মুখ মলিন যায়। দাসপাড়া গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন, ‘হামরা দিনে অ্যানে দিন খাওয়া মানুষ। পোলাপান নিয়ে চিঁড়া-মুড়ি খ্যায়া আছি। ইলিপ দিবে বলে নাম লিখে নিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক ছটাকও ইলিপ পাইনি। ইলিপ না প্যালে মরা ছাড়া গতি নাই।’

সদরপুরে বানভাসিদের ভোগান্তি : ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বানভাসি মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। বিশেষ করে পদ্মার চরাঞ্চলের বানভাসি প্রায় ১০ হাজার মানুষ খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাদের ঘরবাড়িতে চাল ছুঁই-ছুঁই পানি। অনেকে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। গত ১৫ দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় তারা সাহায্য পেয়েছে মাত্র ১০ কেজি চাল। কিছু দুর্গম এলাকায় কোনো সাহায্য পৌঁছেনি। ওই অঞ্চলের নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গন ডুবে যাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

গোবিন্দগঞ্জে গৃহবধূর মৃত্যু : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি গত কয়েক দিন ধরে কমতে থাকলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। নদ-নদীর পানি কমলেও তা বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় মানুষ এখনো নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেনি। রাস্তাঘাটেরও বেহাল অবস্থা। রবিবার রাতে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাজিয়ারচরে ডাকাত দল হামলা চালিয়ে ২৫-৩০টি গরু নিয়ে যায়। বাধা দিতে গেলে ডাকাতের গুলিতে ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ সাতজন আহত হয়েছেন। পরে সারা দিন অভিযান চালিয়ে পুলিশ জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদ এলাকা থেকে লুট হওয়া ২১টি গরু উদ্ধার ও ডাকাতিতে জড়িত সন্দেহে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এদিকে রবিবার সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে বুলি বেগম (৫০) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। বুলি বেগম উপজেলার রামপুরা গ্রামের বাদশা মিয়ার স্ত্রী।

দিনাজপুরে যাতায়াতে ভোগান্তি : বন্যায় ভেঙে যাওয়ায় জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ১২ ইউপির কাঁচা-পাকা অনেক রাস্তায় এলাকাবাসীর চলাচলে ভোগান্তি হচ্ছে। এ উপজেলার ১২ ইউনিয়নে বন্যায় প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে কাঁচা-পাকা রাস্তা ডুবে ও প্রবল স্রোতে পাকা রাস্তার বিটুমিন ও কাঁচা রাস্তা ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে চিরিরবন্দর-বলাইবাজার দিয়ে কুতুবডাঙ্গা, শিমুলতলী-আমতলী, ঘুঘুরাতলী-রানীরবন্দর, বেলতলী-বিন্যাকুড়ি পাকা রাস্তাগুলো বেশি ক্ষতি হয়েছে। এসব রাস্তার কার্পেটিং উঠে গিয়ে ছোট-বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। চিরিরবন্দর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফিরোজ আহমেদ জানান, বন্যায় উপজেলার পাকা রাস্তার ১২২ কিলোমিটারের মধ্যে ১০ কিলোমিটার ও কাঁচা রাস্তা ৬৬৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৬০০ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তার তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর