বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

বর্জ্যে ভরাট ঢাকার নদী-খাল

৪৩ খালের মধ্যে ২৬টি কাগজে আছে বাস্তবে নেই, ১৩টির দশা নাকাল

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যে ভরাট হচ্ছে আশপাশের নদী ও খাল। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় প্রতিদিন আবর্জনা উৎপাদিত হয় প্রায় সাত হাজার টন। নানা জটিলতায় রোজকার বর্জ্য অপসারণ করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক কি শিল্প এলাকা সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে। বৃষ্টি হলে এসব আবর্জনা সরাসরি ড্রেনে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকে ইচ্ছা করেও ড্রেন ও নদীতে বর্জ্য ফেলছে। ফলে এসব বর্জ্যে রাজধানীর বিভিন্ন ডোবা-নালা ও নদী-খাল ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে যত্রতত্র ময়লা পড়ে থাকায় নগরবাসীকে নানা দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। পাশাপাশি রাজধানীতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। জানা গেছে, নগরীর দেড় কোটি মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আরও ৩০ লাখ মানুষ প্রতিদিন বাড়তি বর্জ্য উৎপাদন করছে। ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি দৈনিক অপসারণ করতে পারছে মাত্র চার হাজার টন। বাকি বর্জ্য পড়ে থাকছে রাস্তাঘাটসহ যেখানে-সেখানে। এর সঙ্গে ক্লিনিক্যাল বর্জ্যও যোগ হচ্ছে। অন্যদিকে নগরীর অনেক এলাকায় এখনো স্যুয়ারেজ লাইন নেই। নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়। এ কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করেন না। অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের ২০০৮ সালের এক জরিপে বলা হয়, রাজধানীতে একসময় ৪৪টি খাল ছিল, যার মধ্যে ৩৫টি শুকিয়ে গেছে। অনেক খাল ভরাট করে সড়ক, ড্রেনেজ লাইন করে ফেলা হয়েছে। তবে ঢাকা ওয়াসা এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের যৌথ জরিপের তথ্যমতে, খালের সংখ্যা ৪৩। বর্তমানে ২৬টি খাল আছে শুধু তালিকায়, বাস্তবে নেই। ১৩টি খালের প্রস্থ ১০ ফুটের বেশি নয়। সরকারি দলের লোক হওয়ায় দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, ডিএসসিসি এলাকায় দৈনিক আবর্জনা উৎপন্ন হয় প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে প্রতিদিন অপসারণ করা হচ্ছে ১ হাজার ৯০০ টন। বাকি ১ হাজার ৬০০ টন আবর্জনা যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে। এসব আবর্জনায় ডোবা-নালা ও নদী-খাল ভরাট হচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ডিএসসিসি দক্ষিণের ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৫৫ ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে। হাজারীবাগের কোম্পানিঘাট-সংলগ্ন শাখা নদীতে ডিএসসিসির বর্জ্য বিশাল স্তূপে পরিণত হয়েছে। সেকশন বেড়িবাঁধ থেকে কামরাঙ্গীরচর লোহার ব্রিজ-সংলগ্ন শাখা নদীর পাড়ে প্রতিদিন ডিএসসিসির গাড়িতে করে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। রাজধানীর লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গার শাখা নদীকে ওইসব এলাকার মানুষ আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে আবর্জনা ফেলা হচ্ছে বেড়িবাঁধের ঢালে। ঠিকমতো ওইসব এলাকার আবর্জনা পরিষ্কার না করায় এলাকাবাসী ডোবা-নালাকে আবর্জনা ফেলার স্থান মনে করে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। এদিকে জনবল সংকট ও আন্তবিভাগ সমন্বয়হীনতার কারণে নগর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম শক্তিশালী হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নগর সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীর ৪৩টি খাল দখল করেছে অন্তত ১০ হাজার ৫০০ প্রভাবশালী, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ২১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় সম্পন্ন হয়েছে এ দখল। ২০১০ সালে নগর সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সরকারি এক তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন অবৈধ দখলদারদের ধরতে মাঠে নামলেও পরে রহস্যজনক কারণে তদন্ত থেমে যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসন, জরিপ অধিদফতর থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ছাড়া কার্যত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সূত্রমতে, খাল বেদখলে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করতে ২০১০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মহানগর জরিপের সময় জরিপ কাজে সংশ্লিষ্ট ২১২ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খালের জমি দখলের কাজে সহায়তা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, দখলকৃত কোনো কোনো খালের ওপর ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের কাঁচাপাকা স্থাপনা। তদন্ত রিপোর্টে দখলকারীদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য এবং এ কাজে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচয়েরও উল্লেখ করা হয়। রায়েরবাজার খাল : সুলতানগঞ্জ থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ছিল আড়াই কিলোমিটার। পুরো খালই ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। গোপীবাগ খাল : গোপীবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ছিল। ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। জিরানী খাল : এ খালটি ভরাট করে সায়েদাবাদ থেকে যাত্রাবাড়ী সড়ক করা হয়েছে। সাঁতারকুল খাল : রামপুরার খালটি ভরাট করা হয়েছে। পরীবাগ খাল : শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত আধা কিলোমিটার ভরাট করে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। রামচন্দ্রপুর খাল : মোহাম্মদপুর থেকে কাটাসুর পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্য। বর্তমানে ১৫০-১৬০ ফুট প্রশস্ত। ভরাট করে অফিস, বহুতল ভবন, সরকারি লিজ, কিছু অংশে সড়ক ও আংশিক জীবিত। হাইক্কার খাল : মোহাম্মদপুর থেকে বসিলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার। নতুন করে দুই ধারে দখলের উৎসব শুরু হয়েছে। উত্তরা খাল : এয়ারপোর্ট থেকে টঙ্গী পর্যন্ত এ খালটি। খালের দুই পার প্রভাবশালীরা ভরাট করছেন। মানুষের পয়োবর্জ্যের সরাসরি সংযোগ। সাংবাদিক কলোনি খাল : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর বেনারসি পল্লী এলাকায় অবস্থিত সাংবাদিক কলোনি খাল। দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার। আর প্রস্থ ১০-১৫ মিটার। দুই পাশের দখলে খালটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। কলোনির পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। হাজারীবাগ খাল : জীবিত ২৬টি খালের তালিকায় এটি অন্যতম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ খালটি ব্যক্তিমালিকানায় রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে। এভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে ঢাকার জীবিত অন্য খালগুলোও। ঢাকা জেলা প্রশাসন ও ওয়াসার উচ্ছেদের পর আবার তা দখল হয়ে যাচ্ছে। উদ্ধার, ভরাট, অতঃপর দখল, ফের উদ্ধার এভাবেই চলছে খাল উদ্ধার-দখল খেলা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নগরীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে তা যথাসময়ে অপসারণ করা হলে এসব বর্জ্য কেউ নদী বা খালে ফেলত না। আবর্জনার কারণে রাজধানীর ডোবা-নালা এবং নদী-খাল দূষিত ও ভরাট হচ্ছে। এটি রাজধানীতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এ বিষয়ে কঠোর আইন করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর