বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গোয়েন্দা স্টাইলে মাদক বিক্রি

সাখাওয়াত কাওসার

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও সেই পুরনো চেহারায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চিহ্নিত জেনেভা ক্যাম্প। আবারও শুরু হয়েছে মাদকের ব্যবসা। তবে এবার অনেকটা গোয়েন্দা কায়দায়। কয়েক দফা যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হলেই গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে সর্বনাশা মাদক। স্থানীয়রা বলছেন, চোর-পুলিশ খেলার মতোই চলে জেনেভা ক্যাম্পের মাদকবিরোধী অভিযান। অভিযানের আগেই খবর পৌঁছে যাচ্ছে কারবারিদের কাছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকেই চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের কারবার। ঢাকাকে মাদক পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে তারা।

চলমান অভিযানের অংশ হিসেবে রবিবার রাতে র‌্যাব-১-এর একটি দল রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার নবীনগর হাউজিং প্রকল্পের ৬ নম্বর সড়কের ২৭ নম্বর বাড়ির কাছে অভিযান চালিয়ে মাদক বেচাকেনার সময় ২৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে মো. মামুনুর রশিদ (৩৫) ও মিনারা বেগমকে (৩৫) গ্রেফতার করে। এরা বিহারি ক্যাম্পের পলাতক চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও বহু মামলার আসামি গাঁজা শাকিল ওরফে ইয়াবা শাকিলের সহযোগী। আত্মগোপনে থেকেই ইয়াবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে গডফাদার ইশতিয়াকের ঘনিষ্ঠ এই সহযোগী। অভিযোগ রয়েছে, নাদিম ওরফে পঁচিশ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পেয়েছে আরমান।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গ্রেফতার ব্যক্তিরা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। তারা কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে মাদক ঢাকায় আনে। এরপর ঢাকা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গাসহ সারা দেশে সরবরাহ করে। তাদের কাছ থেকে ২৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া ইয়াবা বিক্রির ৩০ হাজার ৫০০ টাকাও পাওয়া গেছে তাদের কাছে। উদ্ধার মাদকের দাম সোয়া কোটি টাকা।

জানা গেছে, গ্রেফতার মামুনুর রশিদ একজন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। মাদক ব্যবসা ছাড়া মোহাম্মদপুরে তার একটি চায়ের দোকান আছে। চায়ের দোকানের আড়ালে সে ইয়াবা বিক্রি করত। গ্রেফতার অন্যজন মিনারা বেগম পেশায় একজন জ্বালানি কাঠ বিক্রেতা। টেকনাফের দীন মোহাম্মদের মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায় নামে। দীন মোহাম্মদ তাকে মোটা অঙ্কের     টাকার প্রলোভন দেখিয়ে টেকনাফ থেকে ঢাকায় পাঠায়। ইয়াবার চালান ঢাকায় পৌঁছানোর পর সে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে। আর মামুন ইয়াবাগুলো সংগ্রহ করে মোহাম্মদপুর নিয়ে যায়। একাধিক সূত্র বলছে, মাদক ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন অভিনব কৌশল অবলম্বন করে মাদক ঢাকায় আনছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মাদক পাচারের জন্য তারা ট্রানজিট রুট হিসেবে রাজধানী ঢাকাকে ব্যবহার করছে। জব্দ চালানটি মিয়ানমার থেকে নৌপথে কক্সবাজার আনে। সেখান থেকে সড়ক, রেল ও বিমানপথে ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের পলাতক শীর্ষ পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী গাঁজা শাকিল ওরফে গাঁজা শাকিলের সহযোগী বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা ও বিহারি ক্যাম্পে গঠিত মাদকবিরোধী কমিটির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পসহ আশপাশ এলাকায় এখনো চলছে গাঁজা শাকিলের রমরমা ইয়াবা বাণিজ্য। এতে জড়িয়ে পড়ছে বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাসহ আশপাশ এলাকার ছেলেরা। শাকিল বিহারি ক্যাম্পে মাদক বাণিজ্যের সূচনাকারীদের মধ্যে অন্যতম। বেশ কয়েক দফায় মাদকবিরোধী অভিযান চালালেও শাকিল গ্রেফতার হয়নি। গাঁজা শাকিল গ্রেফতার হলে এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা বহুগুণে কমে যাবে। অন্তত অর্ধডজন মামলার আসামি সে। ২০১১ সালে একবার গ্রেফতার হয়েছিল শাকিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার শুরু করে মাদকের ব্যবসা। একসময় নিজে গাঁজা সেবনের পাশাপাশি বিক্রি করত। এজন্য সে ‘গাঁজা শাকিল’ নামে পরিচিত। হালে ইয়াবা বিক্রিতে জড়িত থাকায় সে ‘ইয়াবা শাকিল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ‘অতীতে আমরা অনেক রেইড দিয়েছি। বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা অনেক কমে গেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি এটা সত্য। আবার যদি নতুন করে মাদক কারবারিরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে আবারও রেইড চালানো হবে।’ সরেজমিন জেনেভা ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেছে, ক্যাম্পের প্রায় সব কটি গেটেই সর্বক্ষণ দাঁড়ানো থাকে দু-তিন জন যুবক। কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়বে আরও কিছু মহিলা কিংবা যুবক। কেউ মাদক নিতে ক্যাম্পে ঢুকলেই বিক্রেতারা তা বুঝে যায়। সতর্ক হয়ে ওঠে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সব টিম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিতে মাদক হস্তান্তরের জায়গাও তারা কিছু সময় পরপরই পরিবর্তন করছে। ক্রেতাকে কয়েক গলি পথ পার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পরই নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে মাদক হস্তান্তর করছে কারাবারিরা। সাম্প্রতিক অভিযানের কারণে কিছুটা দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে চার রঙের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। ইশতিয়াক আত্মগোপনে থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ ১৯ সহযোগীর মধ্যে আরশাদ, তানভীর, নাদিম, সেলিম, মনির, আরিফ, মুন্না, সীমা, বিল্লাল, রাজা আরমান, রাকিব, মুক্তার, গুড্ডু, চুন্নু কসাই ও সোলেমানকে দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৬ মে র‌্যাব স্মরণকালের সবচেয়ে বড় অভিযান চালায় উর্দুভাষী অবাঙালিদের বসবাসের মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে। টানা ছয় ঘণ্টার সেই অভিযানে ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০ জুন আবারও জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালায় পুলিশ। টানা প্রায় তিন ঘণ্টার সেই অভিযানে ৫১ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। ৮ জুন ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী পাঁচু ও পাপিয়াকে লালবাগ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ। ৯ জুলাই রাতে মাদকবিরোধী অভিযানে নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয় কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী উর্দুভাষী অবাঙালি নাদিম হোসেন ওরফে বেজি নাদিম ওরফে বোমা নাদিম ওরফে পঁচিশ। ১৯ জুলাই আবারও জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে র‌্যাব ৩৭ জনকে গ্রেফতার করে। এর আগে ২০১৩ সালে পরপর দুই দিনের অভিযানে ভেনেভা ক্যাম্পে দুটি বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কৃত হয়। কারখানা থেকে দুই দিনে ১৩২টি বোমা উদ্ধার করেছিল র‌্যাব। ২০১৬ সালে অভিযানকালে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে চৌদ্দ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয়েছিল। ওই সময় হার্ট অ্যাটাকে এক বয়স্ক মহিলার মৃত্যু হয়। আর সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। ২০১৬ সালে ক্যাম্পের বাসিন্দারা মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ১২ মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে ধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন। ২০১৭ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চালানো মাদকবিরোধী অভিযানকালে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা ক্যাম্পের ভিতর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অন্তত পাঁচজনকে আটকে ফেলেছিল। শেষ পর্যন্ত আর্মড পুলিশ, থানা পুলিশ ও র‌্যাবের সহায়তায় তারা মুক্তি পান।

সর্বশেষ খবর