বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঋণখেলাপের এই দায় সরকারের

-ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ

ঋণখেলাপের এই দায় সরকারের

দেশে খেলাপি ঋণের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এর দায় সরকারের বলে মনে করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন নীতিমালা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। অর্থনীতির এই গুণী বিশ্লেষকের মতে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে একচেটিয়া ব্যবসা- বাণিজ্য সৃষ্টি হচ্ছে, সেটিও ঋণখেলাপির পরোক্ষ কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো উপায়ান্তর না থাকাতেই এই সব একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে অনেকটা জিম্মি হয়ে গেছে এবং ঝুঁকির মুখে পড়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বেসরকারি সংস্থা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) এই  চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সমস্যা বহু আগ থেকে শুরু হয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান। এই ব্যাংকগুলোর ভেতরে পরিচালনার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের দুর্বলতা ছিল। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ক্ষেত্রে বড় দুর্বলতা ছিল। ভ্রান্ত নীতির কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত মান ক্রামগত কমে গেছে। যেহেতু ব্যাংকগুলো সরকারের মালিকানায়, কাজেই দুর্বলতার দায়দায়িত্ব ধারাবাহিকভাবে সরকারগুলোর ওপর বর্তায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কোনো সংস্কারই সফল হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর সমস্যা ভিন্ন ধরনের। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা থেকেও এখানে বেশি দায়ী উদ্যোক্তা-পরিচালকদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ। প্রথম ভুল ছিল, উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ-কাঠামো ছাড়াই আশির দশকের শেষ দিকে বেসরকারি খাতে ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে এসে দেখা গেল, উদ্যোক্তা-পরিচালকরা ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের এক-তৃতীয়াংশের বেশি নিজেরাই ঋণ হিসেবে নিয়ে গেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে খেলাপি হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ ও হাই কোর্টের কিছু বেঞ্চের সক্রিয়তার কারণে প্রায় ৭০ জন উদ্যোক্তা-পরিচালক পদচ্যুত হয়েছিলেন, যার ফলে বেসরকারি ব্যাংকে সুশৃঙ্খলা অনেকখানি ফিরে আসে। কিছু ব্যাংক আন্তর্জাতিক মানেও উন্নীত হয়। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘গত প্রায় এক দশকে এ খাতের নিয়ম-শৃঙ্খলা ক্রমে শিথিল হয়ে গেছে। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে গৃহীত অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপের বিষয়েই আমরা আবার পেছন দিকে হেঁটেছি। বেসরকারি খাতে নতুন নতুন ব্যাংকের অনুমোদনের ফলেও অনেক দুর্বল ব্যাংক তৈরি হয়েছে, যা পুরো খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কিছু গোষ্ঠীর কাছে মালিকানা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যা এ খাতে নতুন ঝুঁকি।’ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘অনেক বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নিজের ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার সংস্কৃতি আবার ফিরে আসছে। কিছু ক্ষেত্রে মালিকানা পরিবর্তনের ফলে একচেটিয়া প্রাধান্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে আমরা দ্বিতীয়বারের মতো আরেকবার ভুল করছি। বাজার অর্থনীতিতে শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে মালিকানার পরিবর্তন হতেই পারে। কিন্তু সেটি ঘটেছে এ খাতের অতি প্রয়োজনীয় একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিরোধ করার মতো অ্যান্টি ট্রাস্ট নীতিমালা তৈরির আগে।’

সর্বশেষ খবর