সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

রেললাইনে লাশ রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

রেললাইনে লাশ রহস্য

রেললাইনে প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, মিলছে লাশ। এ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না রিপোর্ট। ফলে জানা যায় না মৃত্যুর আসল কারণ। আবার কিছু ক্ষেত্রে রিপোর্ট পাওয়া গেলে দেখা যায়, লাশে রয়েছে অন্য রহস্য। মৃত্যুর ধরন দেখে দুর্ঘটনা মনে হলেও দেখা যায়- এ লাশ ছিনতাইকারীরা ফেলেছে অথবা হত্যাকা- চাপা দিতে লাশ এনে রেললাইনে ফেলে দুর্ঘটনা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিমানবন্দর রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে লাগেজের ভিতর থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। লাশটি ছিল পল্লবীর শহীদ জিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী আঁখি আকতারের (১৬)। প্রথম থেকেই পুলিশের সন্দেহ এটি হত্যাকান্ড  হিসেবে বিবেচিত ছিল। পরে জানা যায়, রাজধানীর পল্লবীতে ধর্ষণের পর খুন করা হয় তাকে। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৮ ঘণ্টা ব্যবধানে একই স্টেশন থেকে সাকিব খান (২৫) নামে এক যুবকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, তিনি আগারগাঁওয়ের কৃষি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। পুলিশ ধারণা করে, ট্রেনের ছাদে দাঁড়ানো অবস্থায় স্টেশনের ছাউনিতে ধাক্কা খেয়ে মৃত্যু হয়েছে সাকিবের। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর পাল্টে যায় হিসাব-নিকাশ। বেরিয়ে আসে ওই যুবকের মৃত্যুর অন্য রহস্য। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনা ছাড়াও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো অন্যত্র ঘটে। পরে লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা, যাতে মানুষ মনে করে দুর্ঘটনাজনিত মৃত হয়েছে। গত বছর ৩০ মার্চ সাকিবের অপমৃত্যুর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপ নেয়। এ মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে শুভ (১৯) নামে এক আসামি। এ সময় সাজ্জাদ (২০) নামে একজন সাক্ষ্যও দিয়েছে। দুজনই রেলে পানির হকারি করে। আসামি শুভর জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে সাকিবের মৃত্যুর চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে, রেলের হকাররা ছিনতাই চক্রের সদস্য। ছিনতাইয়ের সময়ই এ চক্রের হাতেই খুন হন সাকিব। আদালতে দেওয়া জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের ভ্রাম্যমাণ পানির হকার শুভ। ৫-৬ মাস আগ থেকে সে, আক্তার, সজিব, সুজন, সেলিম, রফিক ও শাকিল নামে কয়েকজন যুবকের সঙ্গে বিভিন্ন ট্রেনের ছাদে মোবাইল ছিনতাই ও চুরির কাজে জড়িয়ে পড়ে। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ছিনতাই চক্রটির সঙ্গে সেও পুবাইল রেল স্টেশনে অবস্থান করছিল। একপর্যায়ে এরা ধারালো ছুরি নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা কর্ণফুলী ট্রেনের ছাদে ওঠে। তখন ট্রেনের ছাদে ১০-১২ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের মাঝে ব্যাগ হাতে বসা ছিলেন সাকিব। তার কাছে থাকা সব কিছু চেয়ে বসে এই ছিনতাইকারীরা। সাকিব রাজি না হলে তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি ও পরে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে এরা সাকিবকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এতে গুরুতর আহত হয়ে সাকিব জ্ঞান হারান। ছিনতাইকারীরা তখন তার কাছে থাকা মোবাইল ও ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে টঙ্গী রেল স্টেশনে নেমে পড়ে। জানা গেছে, এ খুনের শুভ ছাড়া বাকিরা এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছে। ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানা পুলিশ জানায়, রেল কিংবা লাইনে আগের চেয়ে অপরাধমূলক কাজ কমে গেছে। এরপরও কিছু ঘটনা ঘটলে স্বল্প লোকবল নিয়ে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

দুই কিশোরের লাশ : ২০১৭ সালে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার জোড়াবাড়ী ইউনিয়নের চিলাহাটি রেলপথের মির্জাগঞ্জ রেলস্টেশনের এক কিলোমিটার দূরে মাঝাপাড়া ও সওদাগরপাড়া এলাকা থেকে দুই কিশোরের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। তাদের মুখে কালি মাখানো ও শরীরের পেছনে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এ ঘটনারও পুরো রহস্য এখনো অজানাই রয়ে গেছে। ২০১৩ সালের অক্টোবরে বিমানবন্দর স্টেশন পেরিয়ে টঙ্গীর কাছে রেললাইনের পাশ থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছিল রেলওয়ে থানা পুলিশ। এ ব্যাপারে প্রথমে দুর্ঘটনা হিসেবে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল পুলিশ। কিন্তু নিহতের স্বজনরা যুবককে শনাক্ত করলে তদন্তের মোড় ঘুরে যায়। এরপর পুলিশ তদন্তে জানা যায়-  এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকান্ড । লাশটি যশোরের বাসিন্দা আবু বকরের। তিনি ঢাকা কমলাপুর থেকে চিত্রা ট্রেনের ছাদে উঠে বাড়ি ফিরছিলেন। ওই ছাদেই তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই আবু বকরের মৃত্যু হয়। তার আগে গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ বছর বয়সী ওই অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে অপমৃত্যু মামলা হয়। পরবর্তীতে এ মামলাও হত্যা মামলায় টার্ন নেয়।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, রেললাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না। এ জন্য দুর্বৃত্তরা কাউকে অচেতন করে রেললাইনে ফেলে রেখে হত্যা করতে পারে। আর পুলিশ ভিসেরা পরীক্ষার আবেদন না করায় নিহতদের ভিসেরা সংরক্ষণ করে অচেতনের বিষয়টিও পরীক্ষা করা হয় না। মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ হলে অনেক চিকিৎসক আবার ‘হত্যা’ ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘দুর্ঘটনাজনিত’- এসব কিছুই উল্লেখ করেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর