শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আগামীর অর্থনীতি হবে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের

সুনির্দিষ্ট খাত ধরে সহায়তা দিতে হবে : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিশ্বে আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে : আইএলও

মানিক মুনতাসির

সামনের দিনে দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য আসছে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থেমে গেছে। একই সঙ্গে পরিবহন, পর্যটন, হোটেল, মোটেল, বিশ্ব চিত্রজগৎ, বিনোদন কেন্দ্রসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। বিপুল লোকসানের মুখে পড়ে বহু কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মহামারী রূপ নেওয়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কতটা দীর্ঘায়িত হবে তার ওপর নির্ভর করছে অর্থনীতির ক্ষতির বিষয়টাও। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অন্তত আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বলছে, ২০০৮-২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকেও হার মানাবে এবারের করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সব সদস্য দেশকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছে। সংস্থা দুটি বলেছে, বিশ্ববাণিজ্য থমকে গেছে। আর বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিবার্যভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বিশ্ব শেয়ারবাজার ইতিমধ্যে ২৮-৩৪% হ্রাস পেয়েছে। এ মন্দা দীর্ঘকাল স্থায়ী হলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৫%-এ নেমে যেতে পারে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কভিড-১৯ সংকটটি আমাদের অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক দিক থেকে আঘাত করতে পারে। বিজিএমইএ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে পোশাক খাতে এখন পর্যন্ত বাতিল হয়েছে ২৬৫ কোটি ডলারের ক্রয় আদেশ। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ শ্রমিক। গতকাল ২৬ মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত এ তথ্য দিয়েছে বিজিএমইএ। ৯৫৪ কারখানা থেকে বাতিল হয়েছে এ ক্রয় আদেশ। যেখানে পোশাকের পরিমাণ ৮২ কোটি পিসের বেশি। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত এ আদেশ বাতিল করছে বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়া রপ্তানি খাতের এ ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এরই মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমরা আগাম প্রস্তুতি নিতে পারিনি, এটা পরিষ্কার। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে আমরা যেন একই ভুল না করি। এর প্রভাবে আমাদের ক্ষতি কতটা হবে তা এখনই বলা যাবে না। এ পরিস্থিতি যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি হবে। এজন্য সুনির্দিষ্ট খাত ধরে কী ধরনের সহায়তা দেওয়া যায়, তা নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, এটা আর্থিক প্রণোদনা হতে পারে, নীতিসহায়তাও হতে পারে। এ মুহূর্তে সরকারের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহায়তার চিন্তা না করে একটা আলোচনা করা দরকার। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত, সবার কথা শোনা উচিত। শোনার কাজটা আবার শুধু সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। অর্থনীতিবিদরাও তো উদ্যোগ নিতে পারেন। যেসব প্রতিষ্ঠান সংগঠিত, তারাও উদ্যোগ নিতে পারে। শুধু সরকারের দিকে চেয়ে বসে থাকাটা ঠিক হবে না বলে তিনি মনে করেন। এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের কারণে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। আশঙ্কা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চলেছে করোনা। বাংলাদেশও এ ঝুঁকির বাইরে নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই যুক্ত রয়েছে চীন। এ দেশেও করোনার নেতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি সংকটে দেশের ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে পারে। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে যে সংকট চলছে তাতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। চীনের কারখানা বন্ধের প্রভাব পড়ছে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। করোনার প্রভাবে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা এখন নিম্নমুখী। কারণ চীন থেকে সারা বিশ্বে বেশির ভাগ কাঁচামাল সরবরাহ হয়। করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রভাব পড়েছে দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে। এতে ২০১৯ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রায় ২ লাখ টন ও ২০১৮ সালের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ১০ হাজার টন পণ্য আমদানি কমে গেছে। রপ্তানি খাতও পুরোপুরি বিপর্যস্ত।

সর্বশেষ খবর