শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ওষুধ ছিটাই, মরে না মশা

অতিষ্ঠ নগরবাসী, দেখার কেউ নেই, নতুন বছরে নেই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, দুই সিটির নেই সমন্বিত উদ্যোগ

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

ওষুধ ছিটাই, মরে না মশা

মশায় অতিষ্ঠ রাজধানীর পল্লবী এলাকার বাসিন্দা সুরাইয়া আলম সন্ধ্যার আগেই বাসার দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু এর পরও মশার কামড় থেকে রক্ষা নেই। জানালেন, ‘ছেলেমেয়েরা পড়তে বসলে মশার কামড়ে হাত, পা, মুখে রক্তবিন্দু জমে থাকে। রান্নাঘরে কাজ করতে গেলে কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে মশা। মশা মারতে কয়েল, স্প্রে, বৈদ্যুতিক ব্যাট সবই কিনেছি। কিন্তু কিছুতেই মশার কামড় থেকে নিস্তার পাচ্ছি না।’

শুধু পল্লবী এলাকায় নয়, রাজধানীর উত্তরা, খিলক্ষেত, নিকেতন, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মহাখালী, ফার্মগেট, শাহবাগ, ধানমন্ডি, গুলিস্তান সব এলাকায় মশার পরিস্থিতি প্রায় একই। শীত এলেই বেড়ে যায় কিউলেক্স মশার প্রকোপ। এর মধ্যে রয়েছে  এডিস মশার কামড়ও। মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর, চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় এখন মশার উপদ্রব। ২০২০ সালে বছরব্যাপী ওষুধ ছিটিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কোনো কাজ হয় না। অতিষ্ঠ নগরবাসীকে দেখার কেউ নেই। মশার উৎপাতে দুই সিটিও বিপাকে। কিছু উদ্যোগ নিয়েও তারা ব্যর্থ হয়েছে। নতুন বছরে দুই সিটির নেই ক্রাশ প্রোগ্রাম। এখনো সমন্বিত উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জনের মৃত্যুর পর অনেকটা গা ঝাড়া দিয়ে মশার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল ঢাকার দুই সিটি। কিন্তু সফলতা তেমন আসেনি। ২০২০ সালে পুরো বছরই ছিল মশার উপদ্রব। এমনকি বছরটিতে করোনার বিপর্যয়ের মধ্যেও দুই সিটি নিয়মিত ওষুধ ছিটানোসহ মশা নিয়ন্ত্রণে যাবতীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি জোরদার করেছিল মনিটরিং ব্যবস্থা। এর পরও দেখা দেয় নতুন করে ডেঙ্গুর উপদ্রব। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৪০৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন সাতজন। গত বছর জানুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন, জুনে ২০ জন, জুলাইয়ে ২৩ জন, আগস্টে ৬৮ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন, অক্টোবরে ১৬৪ জন, নভেম্বরে ৫৪৬ জন এবং ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩১ জন। করোনার মধ্যে এখনো ডেঙ্গু আতঙ্কে নগরবাসী। দুই সিটির একাধিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মশা নিয়ে নগরবাসী যে অভিযোগ করছেন, তা আমরা অস্বীকার করছি না। সিটি করপোরেশনও হাত গুটিয়ে বসে নেই। সিটি করপোরেশনের নিয়মিত জোরালো কার্যক্রমের কারণে কিন্তু গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও তা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। আশা করছি নতুন বছরে আমরা সফল হব।’ সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সবার সমন্বিত উদ্যোগে মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থার কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য অষ্টম আন্তমন্ত্রণালয় সভায় যুক্ত হয়ে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ নির্দেশ দেন। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ওষুধ, জনবল ও যন্ত্রপাতিসহ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সবার সমন্বিত, কঠোর উদ্যোগের ফলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। এখন এডিস মশার প্রাদুর্ভাব না থাকলেও অন্য প্রজাতির মশা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।’ একই কীটনাশক দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে মশা সেটিতে সহনশীল হয়ে যায় উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম মশক নিধনে কার্যকর ওষুধ ক্রয়ের পাশাপাশি তদারকি বৃদ্ধির তাগিদ দেন। কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা সাব্বির হোসেন জানালেন, মশার কামড়ে বাড়িতে অতিষ্ঠ অবস্থা। মশারি লাগিয়ে ঘুমালেও শান্তি নেই। মশারির ফাঁক গলে ঢুকে পড়া মশা মারতে গিয়ে রাতের ঘুম নষ্ট হয়। গুলশান-২ এলাকার বাসিন্দা আফরোজা শাহিন বলেন, ‘শীত পড়তেই মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। এ এলাকার আশপাশে খাল-নালার বদ্ধ পানিতে মশার বংশবিস্তার বেড়েছে। মশা নিয়ে খুব ভয়ে আছি। গত মাসে আমার ছেলে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। আর যেন পরিবারে কেউ আক্রান্ত না হয় সে জন্য আমরা খুব সতর্ক থাকছি। কিন্তু মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম বাড়াতে হবে।’ গুলশান সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল জহির স্বপন বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মশার উপস্থিতি বেড়ে যায়। সিটি করপোরেশনের মশার ওষুধ কাজ করলে এ অবস্থা হওয়ার কথা নয়। মশা কামড়ালেই এখন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ভয় লাগে।’ মোহাম্মদপুর এলাকার মুদিদোকানি লিয়াকত আলী বলেন, ‘খালের পানিতে তাকালে যে পরিমাণ মশার লার্ভা দেখি, তাতে মশা কামড়ানো স্বাভাবিক। এসব খাল পরিষ্কার করে ওষুধ ছিটালে মশার কামড় থেকে এলাকাবাসী রক্ষা পেত। মশার কামড়ে দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। কয়েল, স্প্রে দিলেও মশার সংখ্যা কমে না।’ স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান বলেন, ‘গত মাসে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় জরিপ পরিচালিত হয়েছে। সেখানে এডিস মশার ঘনত্ব অনেক কম পাওয়া গেছে। এই সময় খালে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বদ্ধ পানিতে কিউলেক্স মশা বংশবিস্তার করে। খোলা ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার না করলে সেখানে মশার বংশবিস্তারের পরিবেশ তৈরি হয়। সিটি করপোরেশন এসব ময়লা পরিষ্কার করে ওষুধ স্প্রে করলে মশার বংশবিস্তার কমে আসবে।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শীতের সময় কিউলেক্স মশার উপস্থিতি বেড়ে যায়। ড্রেন, জলাশয়ে প্রবহমান পানি না থাকায় মশা বংশবিস্তার করে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা গত বছর ক্রাশ প্রোগ্রাম চালিয়েছি। এখন নিয়মিত কার্যক্রম প্রতিদিনই চলছে। কিউলেক্স মশার বংশবিস্তার রোধে লার্ভিসাইডিং করা হচ্ছে, চলছে ফগিংও। মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা চতুর্থ প্রজন্মের নোভালিউরন ওষুধ প্রয়োগ শুরু করেছি। খুব দ্রুতই মশক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর