রবিবার, ৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

২৫ দিন অনুসরণের পর হত্যা

মির্জা মেহেদী তমাল

২৫ দিন অনুসরণের পর হত্যা

অ তে অজগর, আ তে আম। হারিকেনের আলোতে চার বছরের শাম্মীকে পড়াচ্ছেন তার মা। হঠাৎ শাম্মী তার মায়ের কাছে বায়না ধরে- আম্মু আম খাব। শাম্মীর আবদারে তার মা বলেন, তোমার বাবা তো এখনই বেরিয়ে গেল। আগে কেন বলনি। বাবা আসুক। কাল আম কিনে দিতে বলব। এবার পড় তো মামণি। হঠাৎ গুলির বিকট শব্দ! বেশ কয়েক রাউন্ড পর পর। মা-মেয়ে কেঁপে ওঠে। ভয়ে মেয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কয়েক মুহূর্ত বিরতির পর আবারও কয়েক রাউন্ড গুলি। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মা চিৎকার করে বলেন, আল্লাহ রহম কর। মনে হচ্ছিল ঘরের বাইরেই গোলাগুলি হচ্ছে। গুলির শব্দ থেমে গেছে। কিন্তু শাম্মীর কান্না থামছে না। মা তাকে আদর করে। হঠাৎ শাম্মীর বাবার কথা মনে পড়ে যায় তার। ভাবেন, কিছু সময় আগেই তো তিনি বেরিয়ে গেলেন। তার কোনো বিপদ হলো না তো! অজানা আতঙ্ক মনে। মেয়েকে কোলে নিয়েই ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে পড়েন। ছুটতে থাকেন রাস্তার দিকে। গোলাগুলির কারণে জনমানবহীন সড়ক। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তার মাঝখানে দুটি মোটরসাইকেল দেখতে পান শাম্মীর মা। পাশেই কেউ পড়ে আছে সেখানে। হাত-পা ছুড়ে কাতরাচ্ছে। আলো-আঁধারে তাকে চেনা যাচ্ছিল না। মা-মেয়ে তার কাছেই চলে এসেছে। আরে একি! এ তো শাম্মীর বাবা! গগনবিদারী চিৎকার। দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বলছেন, ‘আমার এত বড় ক্ষতি কে করল!’ শাম্মী তার বাবার রক্তাক্ত দেহের ওপর আছড়ে পড়ে। বাবা তোমার কী হয়েছে, রক্ত কেন? অবুঝ শিশুর কান্না। তখনো বেঁচে আছেন শাম্মীর বাবা। লোকজন চলে এসেছে। ধরাধরি করে তারা কাছের হাসপাতালে নিচ্ছে। এ সময় সবার চোখে পড়ে, মোটরসাইকেলের পাশে পড়ে আছে আরও এক যুবকের রক্তাক্ত দেহ। অপরিচিত। জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট পরা। তার দম নেই। পুলিশ আসে। যুবকের লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। হাসপাতাল থেকে আধা ঘণ্টা পর খবর আসে গুলিবিদ্ধ শাম্মীর বাবা আর বেঁচে নেই। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মিল্কভিটা সড়কে খুন হন টেকেরহাট আলিয়া মাদরাসার সহকারী শিক্ষক মাওলানা বাশার। এশার নামাজ পড়তে বাসা থেকে বের হন তিনি। মসজিদ পর্যন্ত যেতে পারেননি। আগে থেকে ওতপেতে থাকা অস্ত্রধারীরা প্রথমে তাকে গুলি করে। পরে এলোপাতাড়িভাবে কোপায়। হাসপাতালে নেওয়ার কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরও নিহত হয় কিলার গ্রুপের একজন। তার নাম বেলাল শেখ। ২০১৪ সালের ৩১ মে শনিবার সাড়ে ৮টার দিকে রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট বন্দরের মিল্কভিটা সড়কের জোড়া খুনের পর পুলিশ ও গোয়েন্দারা মাঠে নামেন। এ ঘটনায় বাশারের ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা  করেন। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে তেমন কিছু খুঁজে পায় না। পুলিশ কোনোভাবেই দুটি খুনের ঘটনা এক সুতোয় বাঁধতে পারছে না।

বেলাল শেখ পুলিশের তালিকাভুক্ত পেশাদার অপরাধী। আলিয়া মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা আবুল বাশারের সঙ্গে একসঙ্গে কেন খুন হবে, এটি পুলিশের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। বেলাল শেখের পকেট থেকে একটি আবাসিক হোটেলের রুমের চাবি পাওয়া যায়। এজাহারে বাদী ঘটনার  পেছনে স্থানীয় ইউপি নির্বাচন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে। পুলিশ সেদিকটাই তদন্ত করতে থাকে।

গোয়েন্দারা বেলাল শেখের পকেট থেকে পাওয়া চাবি নিয়ে আবাসিক হোটেলে যান। হোটেলের রুম থেকে একটি কাগজের টুকরা উদ্ধার করে পুলিশ। তাতে চারটি ফোন নম্বর ছিল। একটি নম্বরে ফোন করে ওই এলাকা থেকে মহসীন নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে। জেরার মুখে সে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করে। কিন্তু নির্দেশদাতার নাম সে জানে না বলে পুলিশকে জানায়। পুলিশ নিশ্চিত হয়, সে ভাড়াটে খুনি। এদিকে র‌্যাব জানতে পারে কিলার গ্রুপের এক সদস্য শাহীন সীমান্ত পাড়ি দিতে লোকজনের কাছে ধরনা দিচ্ছে। শাহীন তখন রাজধানীর মহাখালীর একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছে। দিনক্ষণ ঠিক করে র‌্যাব-২ প্রস্তুতি নিয়ে যায় ওই হোটেলে। গিয়ে শাহীনকে পায়। তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেফতার করে মাদারীপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। মাদারীপুরে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর জেরা করা হয়। সে ঘটনার কথা স্বীকার করে। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মাত্র ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে খুনিরা এ হত্যাকান্ড ঘটায়। ইউপি নির্বাচনের জের ধরে এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হন আবুল বাশার। খুনের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারায় মতভেদ হওয়ায় একই সময় খুন হন ভাড়াটে সন্ত্রাসী বেলাল শেখ। হত্যাকান্ডের আগে সন্ত্রাসীদের ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় থাকা-খাওয়ার জন্য। খুনিরা ২৫ দিন ধরে বাশারকে অনুসরণের পর হত্যা করে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর