বুধবার, ২৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

এক ভাড়াটে মামলাবাজের কাহিনি

সাখাওয়াত কাওসার ও মাহবুব মমতাজী

তিনি কখনো সাংবাদিক, কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, কখনো নিজেকে পরিচয় দেন এমপি-মন্ত্রীর কাছের লোক হিসেবে। এসব ভুয়া পরিচয়কে বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবিও কারসাজি করে তৈরি করেন তিনি। তারপর কখনো নিজের, কখনো অন্যের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মামলা করেন তিনি। অর্থের বিনিময়ে ভাড়ায় মামলা করাই তার মূল পেশা। দেশের বিভিন্ন আদালত এবং থানায় এভাবেই শতাধিক ভুয়া মামলা করেছেন তিনি।

অবশেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়েছেন এই অভিনব প্রতারক। প্রতারকের নাম আজিজুল হক পাটওয়ারী। পিতা মৃত আবদুল জব্বার পাটোয়ারী। গ্রেফতারের পর নিজেকে তাঁতী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলেও দাবি করেন তিনি। গত ১৬ মার্চ রাতে রাজধানীর মতিঝিলের আরামবাগ থেকে গ্রেফতার হন তিনি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, অভিনব এই প্রতারকের বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী এক নারী। সে মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সারা দেশে তার একটি মামলাবাজ সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার আয়নাতলীর মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে ২০১৬ সালে পরিচয় হয় আজিজুল হক পাটোয়ারীর। পরিচয়ের সূত্র ধরে তার পাওনা টাকা উদ্ধারে সহযোগিতার কথা বলে ৫ লাখ টাকা নেন তিনি। এই টাকা ফেরত চাইলে ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ নারী পাচারকারী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, দেহব্যবসায়ীসহ নানা মিথ্যা অভিযোগে পাঁচটি মিথ্যা মামলা করেন তিনি। যার সবকটিতেই তিনি খালাস পেয়েছেন। কেবল মনোয়ারাই নন, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষ আজিজ পাটোয়ারীর এমন মিথ্যা মামলায় জেল খেটেছেন, হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমনকি মৃত্যুবরণও করেছেন। আজিজুল হক পাটোয়ারী বাদী হয়ে মামলা করেছেন এমন অন্তত ২৪টি মামলার নথি পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই সংখ্যা শতাধিক।

আজিজুল হক পাটোয়ারীর মামলা ও অভিযোগগুলোর নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনা প্রায় কাছাকাছি হলেও থানা বা আসামি ভিন্ন। এমনই একটি মামলা হয় গত ২৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায়। অভিযোগ করা হয়, ফ্রেশ কোম্পানির একটি কাভার্ড ভ্যানের চালক ও ওই কোম্পানির নৈশপ্রহরীরা আজিজুল হক পাটোয়ারী এবং তার সহকর্মী  সোহানকে মারধর ও জখম করে ক্যামেরা এবং ল্যাপটপ ছিনিয়ে নিয়েছেন। এতে তিনজনকে আসামি করা হয়, যার দুজনের নাম থাকলেও ঠিকানা বা পরিচয় অজ্ঞাত। এরপর ওই মামলায় চাঁদপুরের মাদরাসাশিক্ষক ইকবাল হোসেন এবং হোটেল ব্যবসায়ী ইমাম হোসেনকে ধরতে পুলিশ যায় বাসায়। এজাহারে আসামি হিসেবে নারায়ণগঞ্জের ফ্রেশ  কোম্পানির চালক ও নৈশপ্রহরীর কথা বলা হলেও চাঁদপুরের অন্য পেশার দুই ব্যক্তিকে ধরতে পুলিশ  গেল কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, বাদী সম্ভবত তদন্ত কর্মকর্তাকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন। আমরা মিথ্যা মামলা বুঝতে পেরে ইতিমধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি।

ভুক্তভোগী মাদরাসাশিক্ষক ইকবাল হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ১১টি মিথ্যা মামলা করেছেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। এছাড়াও তার ছেলে আবু ইউসুফ পাটোয়ারী আরও তিনটি মামলা করেন। আর বিভিন্ন দফতরে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে ৯২টি। কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ভাঙচুর, কখনো মারধর করে টাকা ছিনতাই, কখনো চাঁদাবাজিসহ অ™ভুত সব অভিযোগ আনা হয়েছে তাতে। এমনও হয়েছে, যে তারিখে ঢাকায় আমি আজিজুল হক পাটোয়ারীর মালামাল ছিনতাই করেছি বলে মামলায় দাবি করা হয়েছে, সেই তারিখে আমি মাদরাসার প্রশিক্ষণে অন্য জেলায় অবস্থান করছিলাম। মূলত, বাড়ির পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে প্রার্থী হওয়ার পর থেকে আজিজুল হক পাটোয়ারী আমার ওপর ক্ষিপ্ত হন।

একই ধরনের মারধর ও ছিনতাইয়ের ঘটনার অভিযোগে গত ১৬ মার্চ আজিজুল হক পাটোয়ারীর সহযোগী মো. সোহান পুরান ঢাকার বংশাল থানায় একটি মামলা করতে যান। তবে আসামি ভিন্ন। থানা পুলিশের ঘটনার বর্ণনা সন্দেহ হওয়ায় মামলা না নিয়ে জিডি করা হয়। মারধর, হামলা ও ছিনতাইয়ের এমন কাল্পনিক অভিযোগের এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করেন আজিজুল হক পাটোয়ারী। মামলা নম্বর ৮/৩৩০। আসামি  সৈকত পালসহ ৪ জন। একই অভিযোগে ওই বছরের ২৭ আগস্ট রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় আরেকটি মামলা করেন পাটোয়ারী। মামলা নম্বর ৪৫/২৮৬। আসামি সেই সৈকত পাল। এখানেই থামেননি তিনি। ২ দিন পরই তিনি আবারও ছিনতাইয়ের শিকার হন পল্টন এলাকায়। পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলা নম্বর ৪৯/৪০৬। আসামি আবারও সৈকত পাল। ঘটনা ও আসামি এক হলেও থানা ভিন্ন। জানতে চাইলে ই-কমার্স ব্যবসায়ী সৈকত পাল জানান, ভালোবেসে স্ত্রী লিমা সাহাকে বিয়ে করার পর থেকেই এই ভোগান্তির শুরু। আমার শ্বশুর হয়রানির উদ্দেশে ভাড়ায় এই মামলাগুলো করেন। আমি তাকে কোনো দিন নিজ চোখে দেখিনি। সব মামলা আদালতে খারিজ হয়েছে। মিথ্যা মামলা করায় আদালত ২১১ ধারায় বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে বলেছে। আজিজুল হক পাটোয়ারীর মামলাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একেক সময় একেক পরিচয় এবং ঠিকানা ব্যবহার করে মামলা করেন তিনি। কখনো কোনো প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা, কখনো প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তির শুভাকাক্সক্ষী, কখনো সাংবাদিক, আবার কখনো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মচারী পরিচয়ও প্রদান করেন তিনি।  অনুসন্ধানে জানা যায়, আসামি ও ঘটনা ভিন্ন হলেও মামলার স্বাক্ষী ঘুরেফিরে কয়েকজনই। কখনো তার  ছেলে আবু ইউসুফ পাটোয়ারী, কখনো সহযোগী সোহান ও আরিফুল ইসলাম, কখনো ভগ্নিপতি সেলিম মিয়া, কখনো ছোট ভাই আলমগীর, কখনো ভাতিজা জামাল। আজিজুল হক পাটোয়ারী ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি প্রতারণা, হয়রানি এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘটনায় শাহরাস্তি থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। এছাড়াও ২০০৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতে প্রেস ক্লাব ও হাই কোর্টের সামনে মানববন্ধন এবং প্রতিবাদ মিছিল করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর