রবিবার, ৩০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি

প্রতিদিন ডেস্ক

ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি

খুলনায় পানিবন্দী মানুষ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বয়ে যাওয়ার চার দিন পেরিয়ে গেলেও সমুদ্র উপকূল এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার মানুষগুলো এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কোথাও তারা লোনা পানির ভিতর বন্দী অবস্থায় রয়েছেন, কোথাও ঘরবাড়িসহ সর্বস্ব হারিয়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন। বিশেষ করে মাছের ঘের, খামার, উঠতি ফসল, ব্যবসা হারিয়ে তারা কঠিন মানবেতর অবস্থায় পড়েছেন। ফলে অনেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করে টেকসই নিরাপত্তার দাবি জানিয়ে চলেছেন। এদিকে প্রশাসন এসব এলাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব মেলানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে যাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য-

কক্সবাজার : কক্সবাজার জেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে ২ হাজার ৫৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে। মাঠপর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। টেকনাফের সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘পূর্ণিমার জোয়ার ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে  দ্বীপের চারপাশ ব্যাপকভাবে ভেঙে গেছে। এখন দ্বীপের অন্তত ১০টি জায়গায় ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দ্বীপটিতে এমন ক্ষতি গত ৫০ বছরেও হয়নি। জেলেদের বেশ কিছু নৌকা ও ট্রলার সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জোয়ারের স্রোতে দ্বীপের একমাত্র জেটিটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেঙে গেছে কয়েকটি অংশে। নড়বড়ে হয়ে গেছে জেটি। এটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনেও প্রবল জোয়ারের পানিতে উপড়ে গেছে গাছপালা। ভাঙন ধরেছে জেটির পন্টুন ও রাস্তাঘাটে। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে বেড়িবাঁধের ব্লকে ধস নেমেছে। এদিকে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ছক অনুযায়ী কক্সবাজার জেলার লবণ, মৎস্য, কৃষিজ, ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, পানের বরজ, বনজসম্পদ ও গ্রামীণ সড়ক কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিরূপণের জন্য মাঠপর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, তিন-চার দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ জানা যাবে। পটুয়াখালী : ইয়াসে মাছের পুকুর, স্লুইজ গেট, কাঁচা রাস্তা, ফসলি জমি, ব্রিজ-কার্লভাট, গাছপালা, কাঁচা ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, গবাদিপশু, হাস-মুরগি খামারের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দী এসব এলাকায় এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কলাপাড়া, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, বাউফল ও গলাচিপা উপজেলায়। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের ও পুকুর। রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান জানান, রাঙ্গাবালী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছের ঘেরের। বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫ কিলোমিটারজুড়ে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ২১টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। সব মিলিয়ে ৬২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রাথমিকভাবে শুকনা খাবার দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম সালেহী জানান, পটুয়াখালী ও কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন পয়েন্টে ৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টি স্লুইজ গেট, আউটলেট ও ইনলেট ও এর অ্যাপ্রোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা এখন মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুলনা : খুলনার উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে ১০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, ৭ হাজার মৎস্য ঘের ও অর্ধলক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ৬০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কয়রা উপজেলার চার ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম লোনা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। কপোতাক্ষ, কয়রা, শাকবাড়িয়া নদীর পানি ৬-৭ ফুট বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার ১১ স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। লোনা পানি ঢুকে ফসলি জমি, মৎস্য, গবাদিপশুসহ প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে সুপেয় পানির সংকট ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাম্প চালিয়েও পানি উঠছে না। যাদের বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় তারাও এখন খাবারের পানি পাচ্ছেন না। ফলে আরও গভীর থেকে পানি উত্তোলনের জন্য সাব-মার্সিবল পাম্প বসাতে অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় সংকট নিরসনে সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপনে বিধিনিষেধ আরোপ, ভবননির্মাণ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার বন্ধসহ আট দফা দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সংগঠনের নেতারা। গতকাল খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবির কথা জানানো হয়। সুপেয় পানি আন্দোলন কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট কুদরত-ই-খুদা বলেন, পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। চলতি বছরে মে মাসে কোথাও কোথাও তা সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৩৭ ফুটে নেমেছে। এর অন্যতম কারণ নিয়ন্ত্রণহীন ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। ৪৬ বর্গকিলোমিটার খুলনা শহরের বাসিন্দাদের আবাসনের চাহিদা মেটাতে গত ১০ বছরে সুপেয় পানির অন্যতম আধার পুকুরগুলো ভরাট হয়েছে, দখল-দূষণের শিকার হয়েছে ময়ূর নদ। নোয়াখালী : হাতিয়া উপজেলার মেঘনা ও বঙ্গোপসাগর উপকূলের অন্তত ২০ হাজার মানুষ চার দিন ধরে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।  হরনী, চানন্দি, সুখচর, সোনাদিয়া, চরঈশ্বর, নলচিরা, তমরদ্দি, নিঝুম দ্বীপ ও জাহাজমারা ইউনিয়নে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে এখনো দিনে-রাতে দুবার জোয়ারের সময় ঘরবাড়ি, মাছের খামার, ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে অনেক মানুষ বেড়িবাঁধ ও সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। চারদিকে পানির কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কৃষি শ্রমিক-দিনমজুররা। দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার এখনো সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো সহায়তা পায়নি। ওয়াকেবহালরা বলেন, দ্রুত ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামত না করলে সহজে এ দুর্ভোগের কবল থেকে মুক্তি মিলবে না। বরগুনা : এ জেলার কৃষি ও মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবল জোয়ারের তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলের মাঠ ও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে রোপা আউশসহ কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া মাছের ঘের তলিয়ে চাষিদের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের দাবি, সিডরের মতো সুপার সাইক্লোনের পর দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ইয়াসে তাদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুর রশীদ জানান, এখন পর্যন্ত জোয়ারের পানিতে বিভিন্ন এলাকার বীজতলা প্লাবিত হয়ে আছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব জানান, বরগুনায় ইয়াসের কারণে জলোচ্ছ্বাসে ছয় উপজেলার ১ হাজার ১২৪৯টি ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ব্রাইট অ্যাগ্রো সার্ভিসের বায়োফ্লোক পদ্বতিতে চাষ করা ৬০ হাজার টাকা মূল্যের কই মাছ বিদ্যুৎ না থাকায় মারা গেছে। পাউবো বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম বলেন, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বরগুনা জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বাঁধগুলো দ্রুত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার হয়েছে।

 

জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে জেলার বিভিন্ন স্থানের বাঁধ ভেঙে ও উপচে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সংশ্লিষ্ট দফতরকে পরিদর্শন পূর্বক ক্ষয়ক্ষতির তালিকা নিরূপণের জন্য বলা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

সর্বশেষ খবর