সোমবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

নতুন মডেল হয়নি, উল্টো বেড়েছে বিশৃঙ্খলা

রফিকুল ইসলাম রনি

নতুন মডেল হয়নি, উল্টো বেড়েছে বিশৃঙ্খলা

আগামীকাল ৪ জানুয়ারি। গৌরব, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের ৭৫ বছরে পা রাখছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ- এককথায় দেশের ইতিহাসের প্রতিটি উজ্জ্বল পর্বে ছাত্রলীগের অনেক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযুক্ত আছে।

তবে অতীত ঐতিহ্য এখন অনেকটাই ম্লান। ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এবার ছাত্রলীগ হবে ‘নতুন মডেল’। তবে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি সেই নতুন মডেল। উল্টো সংগঠনটিতে বিপরীত আদর্শের নেতা-কর্মীদের অনুপ্রবেশ, স্বজনপ্রীতি, বিতর্কিত কর্মকান্ডসহ নানা কারণে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা, হতাশা। করোনাকালে মানবিক কর্মকান্ড প্রশংসিত হলেও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি। নারী কেলেঙ্কারি, ইয়াবা সিন্ডিকেটসহ নানা অপরাধে শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগ। গঠনতন্ত্রে দুই বছরের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রায় সাড়ে তিন বছর পরও সম্মেলন হয়নি। আগামীকাল সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আসতে পারে সম্মেলনের নির্দেশনা। প্রথমে ঢাকা মহানগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ ঢেলে সাজানো হবে। এরপর ওই নেতৃত্বের মাধ্যমেই সারা দেশে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দিয়ে সংগঠনকে উজ্জীবিত করা হবে।

২০১৮ সালের ১১-১২ মে ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলন হয়। দেড় মাস পর জুলাই মাসের ৩১ তারিখ রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি দেওয়া হয়। ১০ মাস পর ২০১৯ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর পর ছাত্রলীগে দেখা দেয় বিভেদ। সে কমিটিতে অছাত্র, বিবাহিত, ব্যবসায়ী, মাদক সম্পৃক্তরা স্থান পেয়েছে বলে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ দেখায় এক পক্ষ। বিতর্কিত হিসেবে ১৯ জনের পদ বাতিল করা হয়। দুর্নীতি, পদ বাণিজ্য, অনিয়ম এবং চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর কিছু দিন পর ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি সংগঠনটির ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা করেন। পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব পাওয়ার পরে বদলে যায় তাদের চরিত্র, হাঁটছেন আবারও শোভন-রাব্বানীর পথে। বিলাসবহুল গাড়ি, ফ্ল্যাটে থাকা আর প্রটোকলে ব্যস্ত তারা। ফোন ধরার সময় নেই আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি, জেলা কমিটি, এমনকি উপজেলা কমিটি থেকেও নিচ্ছেন বিপুল পরিমাণে অর্থ। আওয়ামীবিরোধী পরিবার, বিভিন্ন অপরাধমূলক মামলার আসামি এবং অছাত্র, বিবাহিত ও মাদক ব্যবসায়ী, ছাত্র শিবির-ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দিয়ে করা হচ্ছে কমিটি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে ‘প্রেস রিলিজ’ কমিটি দিতে বারবার নিষেধ করা হলেও তারা মানছেন না সেই নির্দেশনা। 

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই করোনার আঘাত আসে। সে সময় সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা মানবিক কাজ মানুষের কল্যাণে ঝাঁপিয়ে পড়ি। যে কারণে ওই অর্থে সংগঠনকে ঢেলে সাজানো যায়নি। ১২১টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে ২৫টিতে কমিটি করা হয়েছে।’ এরমধ্যে তিনটিতে সম্মেলনের মাধ্যমে, বাকিগুলোতে প্রেস রিলিজ কমিটি করার কথা স্বীকার করেন ছাত্রলীগ সভাপতি। কমিটিতে অনুপ্রবেশ, অর্থের বিনিময়ে কমিটি করার অভিযোগ অস্বীকার করে আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ দিতে পারবে না। যারা ত্যাগী-পরীক্ষিত তাদের দিয়েই আমরা কমিটি গঠন করি। একটি ইউনিটিতে একাধিকজন যোগ্য ব্যক্তি থাকেন। কেউ পদ-পদবি না পেলেই অন্যের চরিত্র হনন ও আমাদের নামে নানা অপবাদ দিয়ে থাকেন।’ 

সূত্রমতে, বিপুল পরিমাণে অর্থ নিয়ে কমিটি করার বিষয়টি আওয়ামী লীগের সব শেষ কার্যনির্বাহী বৈঠকে তুলে ধরেন দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, নেত্রী সহযোগী সংগঠন নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে, বিশেষ করে ছাত্রলীগ জেলায় জেলায় কমিটি দিচ্ছে বিপুল পরিমাণে অর্থ নিয়ে। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না তারা কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে কমিটি দিচ্ছে। তার প্রমাণ মিলেছে কক্সবাজার শাখা ছাত্রলীগের কমিটি, সিলেট জেলা কমিটি ও মহানগর কমিটি, ময়মনসিংহ জেলা কমিটি, সাতক্ষীরা জেলা কমিটি গঠনের পর। ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও সংগঠনের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ছাত্রলীগের নতুন সম্মেলন করার বিষয়ে মতামত জানাবেন তারা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় একটি অংশ সম্মেলনের দাবিতে সংঘবদ্ধ থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পাওয়া ৬৮ জনের বিরুদ্ধে বয়স উত্তীর্ণ হওয়া, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, বিবাহিত, নিজ সংগঠনের নেত্রীকে মারধর ও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, যশোর, নড়াইল, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, সিলেট জেলা ও মহানগরসহ বেশ কয়েকটি জেলা ইউনিটে কমিটি দিয়েছে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে। এসব ইউনিটে কমিটি দেওয়ার আগে ছাত্রলীগের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের চার নেতার কোনো পরামর্শ নেননি বলে অভিযোগ এক নেতার। পরে এসব কমিটি প্রকাশিত হওয়ার পর নানা ধরনের সমালোচনা হয় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে। সম্প্রতি সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে হওয়ায় সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন নেতা-কর্মীরা। তারা অভিযোগ করেন, সাত মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি নাজমুল ইসলামকে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণকান্ডে জড়িতদের আশ্রয়দাতা হিসেবেও পরিচিত। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে বলে ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন।

কক্সবাজারের এক নারীকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগের মূলহোতা আশিকুল ইসলাম আশিকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। ১ জানুয়ারি ঘোষিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেখানে সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজীর বয়স ৩০ বছরের চেয়ে বেশি। আর সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন ছাত্রদল থেকে আসা। একইভাবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক করা হয়েছে অমিত দাসকে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এক যুবকের বান্ধবীকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ওই যুবকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও এটিএম কার্ড ছিনিয়ে ৫০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল। যশোর জেলা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন কবির পিয়াসের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা ও সেবনের অভিযোগ রয়েছে। ফেনসিডিলসহ একবার তাকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ ছাড়া ওই কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ৯ জনের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা, বিবাহিত, অছাত্র ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার  অভিযোগ। ময়মনসিংহ জেলা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া মো. আল আমিন একজন অছাত্র এবং সংগঠনে নিষ্ক্রিয়। এই কমিটির এক নম্বর সহসভাপতি আফজাল এক সময় নাসিরাবাদ কলেজে ছাত্রদল করতেন। অভিযোগ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সব ধরনের অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এগুলো পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। আমাদের হাত দিয়ে কোনো অনুপ্রবেশ ছাত্রলীগে হয়নি। যাচাই-বাছাই করেই কমিটি দিয়েছি। আর অনৈতিক লেনদেনের কোনো প্রশ্নই আসে না। 

সর্বশেষ খবর