বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নেও বাধা

♦ আমলাদের চাতুরীর কারণে বাস্তবায়ন হয় না- পরিকল্পনামন্ত্রী ♦ নিরসন হয়নি আন্তক্যাডার বৈষম্য, সম্পদের হিসাব দিতে কালক্ষেপণ কর্মকর্তাদের, আইএমইডির অফিস হয়নি বিভাগীয় পর্যায়ে, প্রকল্প শেষে নিয়ম মেনে জমা দেওয়া হচ্ছে না প্রকল্পের গাড়িসহ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি

উবায়দুল্লাহ বাদল

তিন বছর আগে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘দেশের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আরও কঠোরভাবে দেখভাল করতে হবে আইএমইডিকে। বিভাগীয় পর্যায়ে তাদের অফিস স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।’ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনার পর এখনো বিভাগীয় পর্যায়ে আইএমইডির অফিস স্থাপনের কাজের কোনো অগ্রগতি নেই।

‘রুলস অব বিজনেস’-এর অজুহাত দেখিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা শাখা অফিস স্থাপনের প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়ে আইএমইডির অধীনে একটি নতুন অধিদফতর গঠনের সুপারিশ করেছে। প্রধানমন্ত্রী পদাধিকার বলে এনইসি চেয়ারপারসন।

একই সভায় প্রধানমন্ত্রী আরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন, প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই পিসিআর বা প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রকল্পের গাড়ি, অফিস ও অন্যান্য সরঞ্জাম জমা দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনাও না মানার অভিযোগ আছে সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, প্রকল্প শেষ হলেও বছরের পর বছর গাড়ি ব্যবহার করছেন কর্মকর্তারা। গাড়ি জমা দেওয়ার তাগিদপত্র দেওয়া হলেও তেমন পাত্তা দেন না সংশ্লিষ্টরা।

এমন পরিস্থিতিতে আমলাদের চাতুরীর কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেছেন, ‘প্রশাসনের অনেক বিধি রয়েছে, যা অপ্রয়োজনীয়। এগুলোর বাস্তবতা নাই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকরা এসব করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ আছে এসব বদলানোর। কিন্তু বদলানো যাচ্ছে না। চতুর ও দুষ্টু আমলারা এসব বিধান চাতুরীর সঙ্গে কাজে লাগাচ্ছেন।’  গত ২৯ জুন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এশিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ‘সরকারি অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এক গণসংলাপে এসব কথা বলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আইএমইডির বিভাগীয় অফিস স্থাপনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের কোনো অফিস মাঠপর্যায়ে থাকতে পারবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী জনস্বার্থে যে কোনো নির্বাহী আদেশ দিতে পারেন। তাই রুলস অব বিজনেস ঠিক রেখে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে আইএমইডির অধীনে একটি অধিদফতর করার চিন্তাভাবনা চলছে।’

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনগণের চাহিদা ও দেশের সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে বিভিন্ন সময়ে নানা জায়গায় প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা দিয়ে থাকেন সরকারপ্রধান। অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আটকে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। ২০০৬ সালের পরিপত্র অনুযায়ী কোনো প্রকল্প শেষ হলে ৬০ দিনের মধ্যে সরকারি যানবাহন পরিবহন পুলে জমা দিতে হয়। কোনো কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে ছয় মাস আগে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। কিন্তু প্রকল্প শেষে প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত গাড়িসহ অন্যান্য অনেক সরঞ্জামের খোঁজ পাওয়া যায় না। প্রকল্প শেষ হওয়া মাত্র প্রকল্প পরিচালক অন্যত্র বদলি হয়ে যান। অনেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে গাড়িসহ যন্ত্রপাতি জমা না দিয়ে প্রকল্পের গাড়ি, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। এসব গাড়ির জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে অনৈতিকভাবে এসব গাড়ি ব্যবহারকে দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এ বিষয়ে দুদক ২০১৯ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পের জন্য ক্রয়কৃত যানবাহন প্রকল্প সমাপ্তির পর সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পরিবহন পুলে জমা প্রদান করার বিধান থাকলেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা উক্ত যানবাহন ব্যবহার করেন, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।’ তারা কিছু বিষয়ে অনুসন্ধান করে সত্যতাও পেয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে। চাকরিতে ঢোকার সময় বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদের হিসাব জমা দিতে হয়। ১৯৭৯ সালে জারি হওয়া সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম করা হয়। কেউ এই নিয়ম না মানায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিধিমালার ১১, ১২ ও ১৩ বিধি কর্মকর্তাদের অনুসরণের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন। এরপর গত বছরের ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন তুলে ধরে বিধিমালা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি পাঠিয়ে এর অগ্রগতি জানাতে বলে। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিলের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংশোধনের নামে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। একইভাবে আন্তক্যাডার বৈষম্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। সব ক্যাডারে প্রথম গ্রেডের পদ সৃষ্টি, সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) পদোন্নতি ও পদসোপান তৈরির নির্দেশনা ৯ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সচিবসভায় আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করে সবার ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি এবং পদায়ন নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরও কোনো অগ্রগতি নেই। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করাসহ ১৬ দফা বাস্তবায়নে স্মারকলিপি দেয় প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি)। ওই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের সংগঠন বিসিএস সমন্বয় কমিটি। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। সমন্বয় কমিটির দাবি, আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করা হচ্ছে। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের মতো সব ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন। এর কার্যকর উপায় বের করতে সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে প্রধান করে কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কমিটির জন্য তিন ক্ষেত্রে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হলেও সুপারনিউমারারি পদোন্নতির বিষয়ে কোনো কাজই হয়নি।

সর্বশেষ খবর