শনিবার, ৩০ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

তদন্তের গ্যাঁড়াকলে ধর্ষণ মামলা

♦ অভিযুক্তদের পাওয়া যাচ্ছে না ডিএনএ নমুনা, সিআইডির হিসাবে ২০ ♦ ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব বলছে ৪০ শতাংশ

মাহবুব মমতাজী

তদন্তের গ্যাঁড়াকলে ধর্ষণ মামলা

ধর্ষণের আসামি না পাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি এবং আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা হয়। আসামির ডিএনএ নমুনা না পাওয়ায় অনেক মামলায় পরীক্ষা অসম্পূর্ণই থাকছে। তাদের গ্রেফতার করতে না পারায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হিসাবে, তাদের ডিএনএ ল্যাবে এ পর্যন্ত আসা ধর্ষণ মামলার নমুনার প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে আসামিদের পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলাবিষয়ক অধিতফতরের অধীনে থাকা ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের হিসাবে এ হার প্রায় ৪০ শতাংশ। আমাদের দেশে ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার জন্য কেবল এ দুটি ল্যাবরেটরি আছে। এর মধ্যে সিআইডির ল্যাবে নমুনা জমা এবং পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার হার বেশি।  আসামির ডিএনএ না পাওয়া গেলে কী হবে? এ প্রশ্নটির উত্তর এখনো পরিষ্কার নয়। এতে ভুক্তভোগীরাও হতাশ। তবে আইনজীবীরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়াও অন্যান্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আসামিদের আদালতে হাজির হতে বলা যেতে পারে।  জানা গেছে, ডিএনএ হচ্ছে একজন ব্যক্তির বংশগতির মৌলিক উপাদান। দুজন মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল কখনো এক হয় না। এমনকি কিছু গবেষণা বলছে, হুবহু যমজদেরও ডিএনএ প্রোফাইল হুবহু এক হয় না। ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের সাহায্যে ন্যূনতম জৈবিক নমুনা থেকেও কোনো ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যায়। ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি এবং অপরাধস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তার ডিএনএ প্রোফাইল করা হয়। তারপর সেগুলোর তুলনা করে মিল বা অমিল খুঁজে বের করা হয়। জৈবিক নমুনা অর্থাৎ রক্ত, লালা, বীর্য, চুল, মাংসপেশি, হাড় ইত্যাদি ডিএনএর গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। পরীক্ষার জন্য যথাযথভাবে আলামত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা খুব জরুরি। সিআইডির অধীনে থাকা ফরেনসিক ল্যাবরেটরির ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন জানান, ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আসা ধর্ষণ মামলায় প্রায় ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে আসামিকে পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে আসামি পলাতক থাকা, অপরাধ স্বীকার করে ফেলা, আসামির সঙ্গে বাদীর মীমাংসা হয়ে যাওয়া।

সিআইডি ও থানা পুলিশ সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলায় ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হয় ১৫ বছরের এক কিশোরী। পূর্বপরিচিত এক তরুণ ও তার দুই বন্ধু মিলে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। পুলিশ আলামত হিসেবে মেয়েটির পোশাক জব্দ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে পাঠায়। কিন্তু তিন আসামির মধ্যে একজনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেনি। বাকি দুজন আসামি শুরু থেকেই পলাতক। একই বছরের মে মাসে বরিশালের কোতোয়ালি থানায় ৪০ বছর বয়সী এক নারীকে ধর্ষণের মামলা হয়। ওই নারীর ডিএনএ সিআইডিতে জমা করা হলেও আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের ডিএনএ পাওয়া যায়নি। 

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি রুমানা আক্তার বলেন, প্রতিনিয়ত সিআইডির ডিএনএ ব্যাংকে বিভিন্ন মামলার নমুনা জমা হচ্ছে। এ ব্যাংকে ৩০ হাজারের বেশি ডিএনএ প্রোফাইল সংরক্ষণ করা আছে। আর ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিটি মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার হার যেভাবে বাড়ছে তা সিআইডির পক্ষে একা সামলানো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। যেসব মামলায় আসামি পলাতক থাকে তাকে যখন পাওয়া যাবে তখনই তার ডিএনএ নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হবে।

ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি সূত্র বলছে, ২০০৬ সাল থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ধর্ষণ মামলায় ৪ হাজার ৬২৯টি মামলার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয় এ ল্যাবে। গত বছর ৮৩০টি ধর্ষণ মামলার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়েছে। আসামি না পাওয়ায় কয়েক বছর ধরে ২০০টির বেশি ধর্ষণ মামলার ডিএনএ পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রয়েছে। এ ল্যাবের অ্যানালিস্টরা বলছেন, ধর্ষণ মামলায় প্রায় ৪০ শতাংশ রিপোর্টই অসম্পূর্ণ থাকে।

বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম এ প্রতিবেদককে জানান, সাক্ষ্যের জন্য ডিএনএ রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ধর্ষণ মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য সারা দেশে ল্যাবের সংখ্যা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে মানসম্মত নমুনাও সংগ্রহ করতে হবে। ধর্ষণ মামলার বিচারে ডিএনএ রিপোর্ট, ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের যথাযথ ভূমিকা না থাকায় দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী। আর যদি আসামির ডিএনএ না পাওয়া যায় তবে আইনি বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।

সিআইডি ফরেনসিক ল্যাব সূত্র জানায়, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৫১টি মামলার ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা নেওয়া হয়েছে। তবে ২০২০ সালের ১ হাজার ৪৮২টি ধর্ষণ মামলার ৫৪ শতাংশ রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের ২ হাজার ৯৩৬টি মামলার ডিএনএ রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে ৬৫ শতাংশ। তারা সঠিক সংখ্যা না জানিয়ে শতাংশটি উল্লেখ করেছে।

সিআইডির ল্যাব ও ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবে হত্যা, ধর্ষণসহ অপরাধের ঘটনা ছাড়াও বিদেশে অধিবাসী হতে ইচ্ছুক, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব প্রমাণ, অজ্ঞাতনামা মৃত ব্যক্তির পরিচয় বের করতে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়।

বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৭৬ জন। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০১ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৪ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ছয়জন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ হাজার ৭৮২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৭৯৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৮৮ জনকে। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১ হাজার ২৮১ জনকে।

মামলায় ডিএনএ বাধ্যতামূলক : ঢাকায় বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা এক নারীকে মাইক্রোবাসে তুলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। অভিযোগ করার পরও সময়মতো মামলা গ্রহণ ও ডাক্তারি পরীক্ষা না করায় ২০১৫ সালের ২৫ মে কয়েকটি নারী ও মানবাধিকার সংগঠন হাই কোর্টে রিট করে। ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিল হাই কোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ধর্ষণের শিকার নারীর বিচারপ্রাপ্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাসহ পূর্ণাঙ্গ একটি রায় দেন। এ রায়ে সব ধরনের ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে রাসায়নিক কিংবা ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সম্প্রতি সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদে র বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ সংশোধন করেছে। সংশোধিত আইনে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর