বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কারাগার থেকে পালানোর ১৭ বছর পর তথ্য ফাঁস

মাহবুব মমতাজী

কারাগার থেকে পালানোর ১৭ বছর পর তথ্য ফাঁস

একটি হেরোইন মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত তিন আসামির পালিয়ে যাওয়ার তথ্য ফাঁস হয়েছে প্রায় ১৭ বছর পর। ওই মামলার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি শুরু হলে গত বছরের মে মাসে কারাগার থেকে আসামির বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

এ ঘটনায় গত বছর ২৪ মে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন হাই কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (ফৌজদারি-১) সিদ্দিকুর রহমান। মামলা নম্বর-২৭। এরপর মামলাটির তদন্ত শুরু করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাল জামিনাদেশ তৈরি করে প্রায় ১৭ বছর আগে কারাগার থেকে পালিয়ে যান তিন আসামি। আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যে তারা এ ঘটনা ঘটান। উচ্চ আদালতের জাল জামিনাদেশ দাখিলের পরই তারা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বেরিয়ে যান। এভাবে কারাগার থেকে বের হয়ে আবারও জড়িত হন হেরোইন পাচারের সঙ্গে।

এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষে চলতি বছর ২৫ জুলাই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মামুনুর রশীদ।

সিআইডির তদন্তে দেখা যায়, ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর মাগুরার শালিখা থানার একটি মামলার রায়ে তিন আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এর শুনানি শেষে উচ্চ আদালতের এক আদেশে ওই তিন আসামি জামিন না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তি লাভ করেছেন বলে জানানো হয়। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জামিন আদেশ তৈরি করে কারাগার থেকে পালানো আবু বক্কর (৬২), গোলাম মোস্তফা (৭৩) ও জালাল উদ্দিনের (৫৬) বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় মামলা করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

গত বছর ৩ জুন মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে সিআইডি। ওই তিনজনের বিরুদ্ধে শালিখা থানার মামলায় যাবজ্জীবন সাজার পর তারা যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজা ভোগ করতে থাকেন। এরপর তারা উচ্চ আদালতে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিল নম্বর-৮৮৩/২০০৩। এরপর পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ আদালতের জামিন আদেশ তৈরি করে ২০০৪ সালে কারাগার থেকে তারা বেরিয়ে  যান। অথচ উচ্চ আদালতে গত বছর ৮ মার্চ ওই আপিলের শুনানিকালে তিন আসামির জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এর পরই আদালত মামলার পর সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, আসামি জালাল উদ্দিন তার চাচাতো ভাই যশোর ঝিকরগাছা উপজেলার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে শালিখা থানার মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। আর শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে আসামি গোলাম মোস্তফার শ্বশুর লুৎফর রহমান যোগাযোগ রাখতেন। এই দুজনকে গ্রেফতার করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি শাহাব উদ্দিন এবং ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর লুৎফর রহমান মারা গেছেন। তবে শাহাব উদ্দিন তার পরিচিত এক আইনজীবীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন করেছিলেন। আর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ডে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের ৮ এপ্রিল বেরিয়ে যান গোলাম মোস্তফা এবং একই বছরের ১৮ এপ্রিল বেরিয়ে যান আসামি আবু বক্কর ও জালাল উদ্দিন। এদের তৈরি করা জাল জামিননামাটি সে সময় মাগুরা ডিসি অফিসে জমা দেওয়া হয়। সেখান থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (এডিএম) দস্তখত হয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। তৎকালীন জেল সুপার ছিলেন আলী আকবর। তিনি ২০০৫ সালে মারা যান। আর ওই জামিননামাটিতে জিম্মাদার ছিলেন যশোরের শার্শা উপজেলার ২ নম্বর লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মহরম হোসেন। তিনিও ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মামুনুর রশীদ এ প্রতিবেদককে জানান, এমন ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনায় গত বছর মামলা হওয়ার এক মাস পরই যশোরে জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং সিআইডির অভিযানে দুজন গ্রেফতার হন। এর পর থেকে তারা কারাগারে আছেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. এহসান হাবিব বলেন, আসলে এসব জালিয়াতি হতো সার্টিফায়েড কপি টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে। আর এসবের সঙ্গে জড়িত আদালতপাড়ার কতিপয় তদবিরকারক। এখন সেগুলো কমে এসেছে। কারণ কড়াকড়ির কারণে এফিডেভিডে আপিলকারীর স্বজনকে সরাসরি উপস্থিত থাকতে হয়। তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য জমা দিতে হয়। আর জাল-জালিয়াতির কারণে অনেক আইনজীবীর সনদও বাতিল হয়েছে। এখনো অনেক টাকার বিনিময়ে এমন কিছু ঘটনা ঘটে। এতে আদালতের কর্মচারীরাও জড়িত থাকেন।

বেরিয়ে আবারও হেরোইন পাচারে : কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও হেরোইন পাচারে জড়ান আসামিরা। এক কেজি হোরোইন পাচারের একটি মামলা বিচারাধীন ছিল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ। এ মামলায় ২০১৬ সালের ৭ এপ্রিল হাজিরা দেন গোলাম মোস্তফা। তখন তিনি আদালতে বলেন, আড়াই কেজি হেরোইন পাচারের মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়ে উচ্চ আদালতের জামিনে আছেন। কিন্তু কোনো কাগজ দাখিল করতে পারেননি। এর পরই তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। তখন থেকে তিনি কারাগারেই আছেন বলে জানা গেছে।

সর্বশেষ খবর