বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ফাঁস প্রশ্নে ইংরেজি পরীক্ষা!

♦ কুড়িগ্রামে ছয় বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসে স্থগিত দিনাজপুর বোর্ডের চার পরীক্ষা, গ্রেফতার ৩ ♦ প্রশ্নফাঁস গুজব নয় গজবে পরিণত হয়েছে

আকতারুজ্জামান

ফাঁস প্রশ্নে ইংরেজি পরীক্ষা!

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় এসএসসি পরীক্ষা শুরুর প্রথম থেকেই অভিযোগ ওঠে প্রশ্ন ফাঁসের। ১৯ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষার আগের রাতেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়। টাকার বিনিময়ে ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের উত্তরসহ প্রশ্নও পাওয়া যায় পরীক্ষার আগেই। এরপর ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই নেওয়া হয়েছে দিনাজপুর বোর্ডের এই দুই পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেয়েছেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। তারা পরীক্ষার অনেক আগে প্রশ্ন পাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে বলেছেন, ‘স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে অবহিত করা হলেও বিষয়টি প্রথমে তারা পাত্তাই দেননি।’

এসএসসির ছয়টি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়ার পর গতকাল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, দিনাজপুর এক বিজ্ঞপ্তিতে চারটি পরীক্ষা স্থগিতের কথা জানায়। স্থগিত করা পরীক্ষাগুলো হচ্ছে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান ও রসায়ন। এ ঘটনায় প্রশ্ন ফাঁসের মূল হোতা কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী নেহাল উ?দ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের সচিব লুৎফর রহমানসহ তিনজনকে আটক করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। তবে সেই পরীক্ষাগুলোর তারিখ পেছনে রয়েছে। এর আগেই নতুন প্রশ্ন ছাপানো হবে। তাই এগুলো স্থগিত করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ছয়টি বিষয়ে শিগগিরই নতুন প্রশ্ন ছাপা হবে।’

ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও পরীক্ষার পর প্রশ্নে মিল পাওয়া যাচ্ছে- অভিভাবক ও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এমন তথ্য জেনে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন।

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আমলে নিয়ে সত্যতা খুঁজতে যান প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিসহ দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। সহকারী পুলিশ সুপার মোর্শেদুল হাসান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা, ওসি আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব মো. লুৎফর রহমানের কক্ষে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার এসএসসির গণিত, কৃষিবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের প্রশ্নপত্র পায়।

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ভূরুঙ্গামারী থানায় এ ব্যাপারে চারজনের নাম উল্লেখ করে, অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভূরুঙ্গামারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে কেন্দ্রসচিব ও প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান, ইংরেজি শিক্ষক আমিনুর রহমান রাসেল ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক জোবায়ের হোসাইন রয়েছেন। মামলার অপর আসামি ক্লার্ক আবু হানিফ পলাতক।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক মন্টু গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষার দিন তিন ঘণ্টা আগে সকাল ৮টায় আমি এক সোর্সের মাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্ন পাই। পরে আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে বিষয়টি জানাই। পরীক্ষা শেষে দেখা যায় হুবহু মিলে গেছে প্রশ্ন।’ তিনি বলেন, ‘ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষার আগের রাতেও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, যা পরীক্ষার পর হুবহু মিলে গেছে।’ পরীক্ষার ফল ভালো দেখাতে স্কুলটির একটি চক্র এভাবে প্রশ্ন ফাঁস করছে বলে জানান তিনি। তবে এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মাকে দফায় দফায় মোবাইলে কল ও মেসেজ দিলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, ‘ইংরেজি প্রথমপত্রের পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন ও উত্তর চলে আসে আমার কাছে। আমি তখনই বিষয়টি অবহিত করতে জেলা প্রশাসককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বার্তা পাঠাই। পরে অন্য সাংবাদিকদের মাধ্যমে পরদিন পরীক্ষার আগেই জেলা প্রশাসককে প্রশ্ন ও উত্তরগুলো পাঠানো হয়।’ ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে বলেও জানান এ গণমাধ্যমকর্মী।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আলোচনার বিষয়টি আঁচ করতে পারি। তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করে ব্যবস্থা নিতে বলি। পরদিন পরীক্ষার আগে কেন্দ্রসচিবকে বাদ দিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেটকোড মিলিয়ে পরীক্ষা নেন। কারণ কেন্দ্রসচিবের ওপর আমাদের আস্থা ছিল না।’

তবে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইংরেজির প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার প্রমাণ আমরা পাইনি।’ তাহলে কোন অভিযোগে প্রশ্ন খুঁজতে কেন্দ্রসচিবের কক্ষ তল্লাশি করা হয়েছিল- এমন প্রশ্নে তিনি উত্তর দেননি।

নেহাল উ?দ্দিন পাইলট বা?লিকা উচ্চবিদ?্যাল?য় কেন্দ্রের পরীক্ষার্থী সুমন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আমি এই কেন্দ্র থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের পরীক্ষার দিন হলরুমে অনেক শিক্ষার্থী আলোচনা করে, তারা প্রশ্নের উত্তরপত্র পেয়েছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আমাকেও নিতে বলেছে অনেকেই। কিন্তু আমি নিইনি। এভাবে যদি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় তাহলে আমরা ভালো পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ!’

প্রশ্ন ফাঁস বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, ‘দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তাই এটি এখন গুজব নয়, গজবে পরিণত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি ভালোভাবে দেখার সুযোগ নেই। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, নাকি ব্যক্তিগত কাউকে সহায়তার উদ্দেশ্যে এসব প্রশ্ন নেওয়া হয়েছে তা তদন্তে জানা যাবে।’

আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, এসএসসি পরীক্ষার জন্য থানার লকারে প্রশ্ন বাছাইয়ের সময় ভূরুঙ্গামারী নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার আবদুর রহমানের যোগসাজশে বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ভিতর বাংলা দ্বিতীয়পত্র এবং ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নপত্রের একটি করে খাম ঢুকিয়ে নেন। পরে প্যাকেট সিলগালা করে এর ওপর স্বাক্ষর করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রহমান। প্রধান শিক্ষক কয়েকজন শিক্ষকের সহায়তায় ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের উত্তরমালা তৈরি করে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেন বলে জানা গেছে। প্রতিটি উত্তরমালা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় করা মামলায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে আসামি না করায় এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে বক্তব্য জানতে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলামকে বৈঠকের পর জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর না দিয়ে দৌড়ে পলায়ন করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর