সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভুয়া ডিবির দৌরাত্ম্যে নাকাল আসল ডিবি

খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে হ্যান্ডকাফ ওয়্যারলেস

সাখাওয়াত কাওসার

থামছে না ভুয়া ডিবির (গোয়েন্দা পুলিশ) দৌরাত্ম্য। একের পর এক অভিযানে ভুয়া ডিবি সদস্যদের গ্রেফতার করা হলেও খোলাবাজার থেকে তারা সংগ্রহ করছে হ্যান্ডকাফ ও ডিবির জ্যাকেট। ভুয়া ডিবির তৎপরতায় বিব্রত হচ্ছেন প্রকৃত গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। আসল ডিবির মতো অভিযানের নামে তারা টার্গেট করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে গাড়িতে তুলে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে এক ব্যবসায়ীকে ভুয়া ডিবির সদস্যরা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পরে ওই ব্যবসায়ীকে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায় মাইক্রোবাস    থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত সদস্যরা ভুয়া ডিবি পরিচয় দিয়ে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। ঢাকা শহরে অন্তত ১০টি ভুয়া ডিবির চক্র রয়েছে। ভুয়া ডিবির দৌরাত্ম্য ঠেকাতে মাস ছয়েক আগে আসল ডিবির সদস্যদের কিউআর কোড-সংবলিত নতুন জ্যাকেট দেওয়া হয়। কিন্তু ভুয়া ডিবির কার্যক্রমের সময় ভুক্তভোগীরাও ডিবি পরিচয়ধারীদের সত্যাসত্য যাচাই করতে পারেন না। শামীম হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী জানান, ১৩ ডিসেম্বর তিনি পল্টনের অফিস থেকে ৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নিয়ে মতিঝিল থানাধীন সিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে রিকশাযোগে যাচ্ছিলেন। সিটি সেন্টারের অলিম্পিয়া বেকারির সামনে একটি মাইক্রোবাস তার রিকশার গতিরোধ করে ডিবি পরিচয় দিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে তুলেই তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে চোখমুখ গামছা দিয়ে বেঁধে রাখে। ঘণ্টাখানেক গাড়িতে রাখার পর তাকে ঢাকা-মাওয়া সড়কের শ্রীনগর এলাকার পিডিএল ক্যাম্পের সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। পরে তিনি প্রথমে শ্রীনগর থানা পুলিশকে জানান। পরে ঢাকায় এসে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ জানান, তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগ ভুয়া ডিবি সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে অভিযান শুরু করেছে। শিগগিরই এই চক্রটিসহ অন্যদের গ্রেফতার করা হবে।

গোয়েন্দা-সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের ভুয়া ডিবি চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হলেন শহীদ নামে এক ব্যক্তি। এর আগে একাধিকবার তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আবারও তিনি আগের মতোই ভুয়া ডিবি সেজে ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করে নিচ্ছেন। ভুয়া ডিবি চক্রে তাকে সবাই ‘ডিসি স্যার’ হিসেবে চেনে।

গোয়েন্দা-সংশ্লিষ্টরা জানান, ভুয়া ডিবি চক্রের অন্যতম হোতা শহীদ সব সময় ফিটফাট হয়ে চলাফেরা করেন। মাসিক ভাড়ায় গাড়ি নিয়ে চলেন। তার মোবাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম দিয়ে বিভিন্ন ভুয়া নম্বরও সংরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে বলেও নানা জনের কাছে প্রচার করেন। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অন্তত দেড় ডজন মামলা রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুয়া ডিবি হিসেবে ছিনতাই করে বেড়ানো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক একজন সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি একটি বাহিনীতে চাকরি করতেন। চাকরি চলে যাওয়ার পর একজনের মাধ্যমে তার সঙ্গে শহীদের পরিচয় হয়। শহীদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি কয়েকজন সহযোগীসহ ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় ঘুরতেন। টার্গেট ঠিক করে দিতেন শহীদ নিজেই। টার্গেট ব্যক্তির শারীরিক বর্ণনাসহ অবস্থান জানানোর পর তারা ভুয়া ডিবি পরিচয় দিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নিতেন। পরে শহীদ এসে তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিতেন।

ভুয়া ডিবির ওই সদস্য জানান, তাকে হ্যান্ডকাফ ও ওয়্যারলেস সেট এবং গোয়েন্দা পুলিশ লেখা কয়েক সেট জ্যাকেটও দিয়েছিলেন শহীদ। সাধারণত ডিবি সেজে অপারেশনের সময় হ্যান্ডকাফ দেখেই কেউ কোনো প্রতিবাদ করত না। কোথাও ঝামেলা হলে তারা গাড়ি থেকে গোয়েন্দা পুলিশ লেখা জ্যাকেট বের করতেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ভুয়া ডিবি পুলিশের তৎপরতা বেশি থাকে ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন অজুহাতে ব্যাংকের ভিতরে অবস্থান করে কারা বেশি পরিমাণ অর্থ তুলছেন সেই খবর বাইরে থাকা চক্রের অপর সদস্যদের দিয়ে দেয়। একই কৌশল নিয়ে থাকে মানি এক্সচেঞ্জের ক্ষেত্রেও। তবে এসব চক্রের সঙ্গে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মচারীও জড়িত। গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, ভুয়া ডিবি পুলিশের বেশির ভাগ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বহিষ্কৃত সদস্য। তারা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে বেশি। কারণ হুন্ডি ব্যবসায়ীরা নিজেরাও অবৈধ অর্থ বহন করেন বলে অনেক সময় ভুয়া ডিবির দ্বারা ছিনতাইয়ের শিকার হলেও থানা পুলিশের দ্বারস্থ হতে চান না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, গত এক বছরে অর্ধশতাধিক ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু জামিন নিয়ে তারা আবারও একই কাজ করে যাচ্ছে। শহীদ ছাড়াও নাছির, জামাল, পারভেজ, জসিম, সাইফুল, পীযূষ ও জাহাঙ্গীর নামে একেক ব্যক্তি একেকটি ভুয়া ডিবির দল পরিচালনা করে থাকেন।

হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকিসহ পুলিশের ব্যবহৃত অভিযানিক উপকরণ খোলাবাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও হ্যান্ডকাফসহ ওয়াকিটকি খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর পলওয়েল মার্কেটসহ পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় এসব বিক্রি হয়। এ ছাড়া খোলাবাজারে চীনের উৎপাদিত এমন খেলনা পিস্তল বিক্রি করা হয়, যেগুলো একেবারে হাতে না নিলে বোঝার উপায় নেই এগুলো আসল না নকল। একই সঙ্গে চাইলে ডিবি বা গোয়েন্দা পুলিশ লেখা জ্যাকেটও সংগ্রহ করা যায় খোলাবাজার থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, খোলাবাজারে খেলনা পিস্তল কিনে অনেকেই ছিনতাই করে বেড়াচ্ছে। রাতের অন্ধকারে বা কারও হাতে পিস্তল দেখলে সাধারণত ভুক্তভোগীরা প্রাণভয়ে প্রতিবাদ করতে চান না। এ ছাড়া যদি আসল পুলিশের হাতে থাকা অন্যান্য উপকরণ, বিশেষ করে ওয়াকিটকি ও হ্যান্ডকাফ দেখেন তাহলে প্রথম দেখাতেই আসল পুলিশ মনে করেন। এ সুযোগ নিয়ে ভুয়া ডিবির সদস্যরা নিয়মিত অপকর্ম করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর