সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

আমানতে সুদ সীমা উঠল, বাড়ল ভোক্তা ঋণে

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাড়ল নীতিসুদ হার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমানতে সুদ সীমা উঠল, বাড়ল ভোক্তা ঋণে

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিসুদ হার বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর টাকা ধার নেওয়ার (রেপো) সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সঙ্গে আমানতের সুদহারের সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। সীমা তুলে নেওয়া হয়েছে ভোক্তাঋণের সুদহারও। এখন থেকে ব্যাংকগুলো ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিতে পারবে ভোক্তাঋণে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে এসব সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস) বা মুদ্রানীতি প্রকাশ করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, এ কে এম সাজেদুর রহমান খান, বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ গবেষণা বিভাগের কর্মকর্তারা।

আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, এবারের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির সহনশীলতা (রেজিলিয়েন্স) অত্যন্ত গভীর। যে কোনো একটা ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে না। রোজার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এসব পণ্য আমদানির জন্য দিনে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০টি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হচ্ছে। গভর্নর বলেন, নীতিসুদ হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ তফসিলি ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ নিলে দিতে হবে ৬ শতাংশ সুদ, যা আগে ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকগুলো যদি বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা জমা রাখে তাহলে ৪ শতাংশের পরিবর্তে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ (রিভার্স) সুদ পাবে। নীতিসুদ হার বাড়ানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। এ তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে ৪-৫ শতাংশ সুদে অর্থ নিতে পারবে। এতে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি সুদে স্বল্পমেয়াদে টাকা ধার নিতে হবে না। দ্বিতীয়ার্ধে মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ১২ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হয়েছে। আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘এখন থেকে ব্যাংকগুলো যে কোনো রেটে (সুদহার) আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। ডিপোজিট রেটে কোনো ক্যাপ নেই। মুদ্রানীতিতে এটা বলে দিয়েছি। আর ভোক্তাঋণের সুদহার ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজার ও সুদহারের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে মুদ্রানীতি করা হয়েছে। আগামীতে খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করতে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ গভর্নর বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানত বেড়েছে ৮ শতাংশ। ব্যক্তিগত আমানত বাড়লেও কমেছে প্রাতিষ্ঠানিক আমানত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেও একই লক্ষ্য ছিল। তবে এ লক্ষ্য আগের অর্থবছরে ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে বাজেটের বিশাল ঘাটতির অর্থায়নে সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ঋণে জোর দেবে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বেশি। আগের বছর সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২) ব্যাংক থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। তবে অন্যদিকে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিয়েছে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ শোধ করেছে ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট বা প্রকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে সেই পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে মুদ্রানীতিতে।

সর্বশেষ খবর