২০১০ সালে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে র্যাব এক যুবককে অপহরণ করে। চেতনানাশক ছাড়াই তার ঠোঁট সেলাই করে দেয়। এ ছাড়া অনেককে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হতো। লাশ সিমেন্টের ব্যাগে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। যেসব নদীতে লাশ গুম করা হতো, তার মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা। নদীতে লাশ ফেলার জন্য ঢাকার পোস্তগোলা ও কাঞ্চন ব্রিজ ব্যবহার করা হতো। তার আগে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো ৮টির বেশি গোপন বন্দিশালায়।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরের ১ হাজার ৬৭৬টি এমন গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টি অভিযোগ। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে নৃশংস নির্যাতনের এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনের ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ রবিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে সরবরাহ করেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।
তদন্ত কমিশন জানায়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), র্যাব ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের মতো সংস্থাগুলো গোপন বন্দিশালা পরিচালনা করত। দেশজুড়ে এসব গোপন বন্দিশালায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের আটকে রাখা হতো। এর পাশাপাশি গুমের শিকার ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে সাধারণ বন্দিদের সঙ্গেও রাখা হতো। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের কীভাবে দিনের পর দিন সবার চোখের আড়ালে বন্দি করে রাখা হতো, তা উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদে বন্দি করে রাখা হতো। তাদের ৪৮-৬০ ঘণ্টা থেকে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি কয়েকজনকে আট বছর পর্যন্ত বন্দি করে রাখা হয়।
তবে গুম হওয়ার পর জীবিত ফিরে আসতে পারা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারে বেরিয়ে এসেছে, অনেককে এমন সব বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল, যেখানে সাধারণ বন্দিদেরও রাখা হতো। এর উদাহরণ হিসেবে ডিবির হাতে বন্দি ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে বৈধ ও অবৈধ বন্দিদের একই বন্দিশালায় রাখার কারণে গুমের শিকার ব্যক্তিরা বন্দিদশায় কী জটিল অবস্থার মধ্যে থেকেছেন, তা ধারণা করা যায়।
গুম কমিশন বলেছে, খুব সম্ভবত গুমের শিকার ব্যক্তিদের বৈধ বন্দিদের সঙ্গে রাখার মাধ্যমে তাদের অবৈধভাবে আটক রাখার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো।
এ ছাড়া বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার থেকে কমিশন একই বন্দিশালার ওইসব এলাকা চিহ্নিত করতে পেরেছে, যেখানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে সাধারণ বন্দিদেরও রাখা হতো। একই বন্দিশালায় এভাবে অবৈধ ও বৈধ বন্দিদের পালা করে রাখার বিষয়টি কমিশন গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধভাবে আটক ব্যক্তিদের আড়াল করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয় এবং এ বিষয়ে পরবর্তীকালে আরও তদন্তের প্রয়োজন।
গোপন বন্দিশালা দেখতে তদন্ত কমিশন যেসব দপ্তরে গেছে সেগুলো হলো- ডিজিএফআই, সিটিটিসি, ডিএমপির ডিবির প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ডিবি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ইউনিট ২, ৪, ৭ ও ১১, র্যাব ২, সিপিসি ৩, র্যাবের সদর দপ্তর, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এবং এনএসআইয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়। র্যাবে কর্মরত একজনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এক ভুক্তভোগী নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। পরে তাকে উদ্ধারের পর সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকটি ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, একটি লাশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল। আরেকটি ঘটনায় তুলে নেওয়া এক ব্যক্তিকে সড়কে চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তবে গাড়িটি পাশ কেটে চলে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।