রহস্য কাটছে না রাজধানীর মগবাজারের আবাসিক হোটেলে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায়। পুলিশ বলছে, খাবারে বিষ মিশিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে জড়িত থাকার সন্দেহের তীর মারা যাওয়া সৌদী প্রবাসী মনিরের কেয়ারটেকার রফিকুলের দিকে। ঘটনার কারণ জানতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের কাছে হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন রফিকুল। ইতোমধ্যে মামলাটির তদন্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রমনা থানা পুলিশ।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম ফারুক এ প্রতিবেদককে বলেন, কেয়ারটেকার রফিকুল কোনো কিছু স্বীকার করেননি। খাবারের সঙ্গে বিষ মিশানো হয়েছিল কি না তা নিশ্চিত হতে ভিসেরা প্রতিবেদন এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। যে খাবার খেয়ে হোটেলে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে সে খাবার তাদের কাছে রফিকুলই সরবরাহ করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদি ফুড পয়জনিং জনিত কারণে মৃত্যু হতো তাহলে তো অন্য যারা খাবার খেয়েছেন তারাও অসুস্থ হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের অসুস্থ হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গত ২৮ জুন মনির হোসেন এবং তার স্ত্রী স্বপ্না তাদের ছেলে নাঈমের চিকিৎসার জন্য হোটেল সুইট স্লিপ-এ ওঠেন। পরদিন সকালে এক আত্মীয় এসে দেখেন, স্বপ্না অসুস্থ হয়ে বমি করছেন। পরে স্বপ্না ও নাঈমকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। কিছুক্ষণ পর মনিরও অসুস্থ হয়ে মারা যান। মগবাজারের একটি রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে লাশ তিনটির ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, খাদ্যে বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে। আর এই খাদ্যে বিষক্রিয়ার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশের তদন্তেও গতি এসেছে। হোটেল থেকে আনা খাদ্যে সমস্যা ছিল, নাকি খাদ্যে বিষ মেশানো হয়েছিল-এ নিয়েই পুলিশের নানা প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে ভিসেরা ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য।
জানা যায়, সৌদি প্রবাসী মনির হোসেন তিন সন্তানের বাবা। বাকি দুই ছেলে ১৪ ও ৯ বছর বয়সি। তারা ঘটনার সময় গ্রামের বাড়িতে ছিল।
এ ঘটনায় গত ১ জুলাই ইতালি থেকে দেশে ফিরে মামলা করেন মনিরের ভাই নুরুল আমিন মানিক। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, চাচাত চাচা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার ভাই মনিরের ভালো সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদে তার ভাইয়ের ঢাকাসহ গ্রামের বাড়ির জায়গা-জমি রফিকুলই দেখাশোনা করতেন। বেশ কিছুদিন আগে টাকা-পয়সা নিয়ে রফিকুলের সঙ্গে মনিরের ঝগড়া বিবাধ হয়েছিল। মগবাজারের হোটেলে ওঠার পর রফিকুলই ভর্তা ভাত রেস্তোরাঁ থেকে মনির ও তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিনে আনেন। এরপর তিনি তার বাসায় চলে যান। সেই খাবার খাওয়ার পরই বমির পর অসুস্থ হয়ে ওই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মনিরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পরিকল্পিত এই হত্যাকা ঘটানো হয়েছে।
পুলিশ ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর পোস্তগোলায় মনির হোসেনের একটি পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি বাসও রয়েছে তার মালিকানায়। এসব দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন কেয়ারটেকার রফিকুল ইসলাম। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করছে।
ময়নাতদন্তের পর ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. জাকিয়া তাসনিম জানিয়েছেন, তিনটি লাশের লক্ষণ দেখে প্রাথমিকভাবে তাদেরও মনে হয়েছে এটি খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যু। তবে নিশ্চিতভাবে জানতে লাশ থেকে সংগৃহীত রক্ত ও ভিসেরা নমুনা মহাখালীর পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন এলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।
এর আগে রমনা থানার এসআই জালাল উদ্দিন লাশ তিনটির সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। তিনি বলেন, তিনটি লাশের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। সুইট স্লিপ হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মারা যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় একটি ব্যাগে খাবার নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করেন রফিকুল। পরে তিনি চলে যান। রাত ৮টায় মনির হোসেন নিচে নেমে পানি নিয়ে ওপরে নিজের কক্ষে ফেরেন। তারা অসুস্থ হলেও হোটেল কর্তৃপক্ষকে কিছু জানাননি। রবিবার বেলা ১১টায় রফিকুল হোটেলে ফিরে আসেন। প্রথমে স্বপ্না আক্তারকে নিয়ে পাশের আদ-দ্বীন হাসপাতালে যান তিনি। আধা ঘণ্টা পর নিয়ে যান মনির হোসেনকে। এরপর হোটেল কর্মীরা নাঈমকে অচেতন অবস্থায় দেখে হাসপাতালে নিয়ে যান।
আদ-দ্বীন হাসপাতাল সূত্র জানায়, হাসপাতালে আনার আগেই তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। পরে পুলিশ লাশ তিনটি ঢামেক মর্গে পাঠায়।