আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, শেখ হাসিনা ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে একজন কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। বিচার বিভাগ কলুষিত করার দায় সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের আইনজীবীর জেরার প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার মাধ্যমে নিশ্চিত হোক বাংলাদেশে যেন গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি আর না হয়। জুলাইয়ের শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এ গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি দেন মাহমুদুর রহমান। পরে তাঁকে জেরা শুরু করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তার জেরা শেষ না হওয়ায় পুনরায় জেরার জন্য আজকের দিন ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ।
এ মামলায় আরেক আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। সাক্ষ্য গ্রহণের সময় গতকালও তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির ছিলেন। সকালে কারাগার থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে আনে পুলিশ। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে মাহমুদুর রহমান তার দ্বিতীয় দিনের জবানবন্দিতে বলেন, ‘সেই তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণহত্যা চালানোর জন্য সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র কর্মকর্তাদের সরাসরি নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ওপর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির দায় পড়ে।’
জবানবন্দিতে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যে আরব রেভল্যুশনের সময় মিসর এবং তিউনিসিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন দেখেছি। বাংলাদেশেও ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইতালি এবং জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি এবং হিটলারের পতন হয়েছিল যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার ১৫ বছরের চরম দুর্নীতি পরায়ন এবং মানবতাবিরোধী শাসনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জনগণের প্রত্যাশা হলো আর যেন কখনো আমাদের দেশে এমন ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রত্যাবর্তন না ঘটে।’
তিনি বলেন, ‘ জুলাইয়ের শহীদ পরিবারগুলো ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায়। এর সঙ্গে আরও অন্তত ২০ হাজার আহত জুলাই যোদ্ধা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তারাও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কমান্ড রেসপনসিবিলিটিতে যারা ছিলেন তাদের বিচার দেখতে চান। এই আসামিদের মধ্যে যারা সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যারা উক্ত হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই, তারা সবাই কমান্ড রেসপনসিবিলিটির আওতাভুক্ত।’
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আমি বিগত ১৬ বছর ধরে এই ফ্যাসিবাদের উত্থান, বিকাশ এবং পতন প্রত্যক্ষ করেছি। এ বিষয়ে অনবরত লেখালেখি করেছি এবং বিভিন্ন সভা, সেমিনার ও মিডিয়ায় বক্তব্য দিয়ে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেছি। জুলাই গণহত্যার পর যখন এ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে আমি মনে করেছি রাষ্ট্রের একজন বর্ষিয়ান নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য ট্রাইব্যুনালকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্বক সহযোগিতা করা। সেই সহযোগিতার অংশ হিসেবে আমি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করছি।’
মাহমুদুর রহমান বলেন, আমি চাই অপরাধীরা যেন সাজা পায়, শহীদ পরিবার, আহত জুলাই যোদ্ধা এবং তাদের পরিবার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে তাদের শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। এ ছাড়া ফ্যাসিস্ট শাসনের বিষয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভবিষ্যতের সরকারসমূহ সতর্ক হবে বলে আমি প্রত্যাশা করি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেভাবে বলা হয়েছিল ‘নেভার এগেইন’ বাংলাদেশেও এই বিচারের মাধ্যমে নিশ্চিত হোক যেন গত ১৫ বছরের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি আর না হয়।
পরে জেরার একপর্যায়ে আইনজীবী আমির হোসেন মাহমুদুর রহমানের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি জবানবন্দিতে বলেছেন, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগের নামে তামাশা’ লেখার মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। এটা আপনি সঠিক কাজ করেননি।’ জবাবে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমার এই লেখার পর শেখ হাসিনার পরবর্তী ১৫ বছরের শাসনামলে প্রমাণ হয়েছে আমি সঠিকভাবেই জাতিকে সতর্ক করেছিলাম। শেখ হাসিনা ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে একজন কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। সুতরাং বিচার বিভাগ কলুষিত করার দায় সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।’