করোনার পর এবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নতুন করে বিপাকে পড়তে পারেন দেশের গার্মেন্টস শিল্প ব্যবসায়ীরা। করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল পরিমাণে কার্যাদেশ হারিয়েছে দেশ। এরপর গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে প্রচুর কার্যাদেশ এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতিশীল হয়ে ভিয়েতনামকে প্রতিযোগিতায় পেছনে রেখে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু করোনার সেই ক্ষতের অংশে দুই দেশের যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতে আসবে বলে উদ্বেগ্ন ও শঙ্কায় রয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরে করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্ববাজারে মন্দা চলছিল। ঠিক এর পরই নতুন করে যখন দেশের ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন সে মুহূর্তে এ যুদ্ধ তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধে গার্মেন্ট খাতে ঠিক কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা বোঝার জন্য ব্যবসায়ীরা আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে চান। বর্তমানে পুরো বিষয়টি তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
এ যুদ্ধ চলমান থাকলে নতুন করে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং রাশিয়ার বাজারে কার্যাদেশ বাতিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস মালিক-ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই চলেছে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। পোশাক শিল্প ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য। সে তুলনায় ইউক্রেনে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম হলেও রাশিয়ার বাজার মাঝারি আকারের রয়েছে। চলমান এ যুদ্ধের কারণে দুই দেশের ব্যবসাসহ নানা ক্ষেত্র স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধের কারণে এর প্রভাব যদি আশপাশের ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পুরো পোশাকশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির ৬০-৬১ শতাংশের গন্তব্য ইইউভুক্ত দেশ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম মান্নান কচি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাশিয়ায় আমাদের তৈরি পোশাক খুব কম যায়। আশা করছি এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে না। যদিও বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে চলেছে। এ সংকট দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছি। দেশের পোশাক খাতের ওপর এ যুদ্ধের প্রভাব কেমন হবে তা বলতে আরও কিছুদিন পোশাক ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করতে হবে। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। মাত্রই যখন করোনা নিয়ন্ত্রণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক সে সময় এ ধরনের যুদ্ধ স্বাভাবিকভাবেই পুরো বিশ্বকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আমরা বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এ যুদ্ধ এবং একে ঘিরে আমাদের খাতের ওপর কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে কি না তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুই দেশের যুদ্ধের প্রভাবের কারণে স্বাভাবিকভাবেই আমরাও শঙ্কায় রয়েছি। এ যুদ্ধের মাত্রা বা ক্ষতি যদি আরও বেড়ে যায় তাহলে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এ ছাড়া এসব বিষয়ে আরও এক সপ্তাহ পর বোঝা যাবে কী হচ্ছে, কী হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে স্বাভাবিক সময়ে ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার ডলার খরচ পড়ত। সেখানে পণ্য পরিবহনে এখন ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার ডলার খরচ পড়ছে। এর আগে করোনার কারণে দারুণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিপুল পরিমাণ কার্যাদেশ আমরা হারিয়েছি। তবে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের প্রচুর কার্যাদেশ এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা গতিশীল হয়ে আমরা ভিয়েতনামকে প্রতিযোগিতায় পেছনে রেখে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো এখন কৃষ্ণ সাগরে যেতে চাইছে না। ফলে রপ্তানিকারকরাও চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। ইউক্রেনের ওপর হামলার জেরে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানসহ একাধিক দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার বেশির ভাগই অর্থনৈতিক।
তারা বলছেন, তৈরি পোশাক ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক, চামড়া, জুতা, সিরামিক, খেলনা, ম্যাট্রেস, হিমায়িত খাদ্য, পাট ইত্যাদি রপ্তানি হয়। আর ইউক্রেনে পোশাকের বাইরে ওষুধ, প্লাস্টিক, জুতা, ম্যাট্রেস, খেলনাসহ বিভিন্ন পণ্য যায়। সব মিলিয়ে যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে জানান তিনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৫৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, দেশি মুদ্রার যা ৫ হাজার ৭৪ কোটি টাকার সমান। অন্যদিকে ইউক্রেনে রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ডলারের বা ১০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক।
করোনার কারণে এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ ভাড়া উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এখন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এতে জাহাজ ভাড়া আরও বেশি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের একজন পরিচালক বলেন, আগের বাড়তি জাহাজ ভাড়াটাই এখন স্বাভাবিকে পরিণত হয়েছে। নতুন করে জাহাজ ভাড়া বাড়েনি। এখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ স্থায়ী হলে আবারও জাহাজ ভাড়া বাড়বে এবং ইউরোপের বাজার অস্থিতিশীল হবে। তবে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা বিবেচনা করতে হবে বলে জানান তিনি।