২৪ মে, ২০২২ ১৩:৩৮

নক্ষত্রের পতন অশ্রুসিক্ত স্মৃতি তর্পণ

শামসুল আরেফিন খান

নক্ষত্রের পতন অশ্রুসিক্ত স্মৃতি তর্পণ

আবদুল গাফফার চৌধুরী

পরম সৌভাগ্য আমার, জন্মেছিলাম ১৯ শতকে, রবীন্দ্রনাথের বাংলায়, জীবনানন্দ দাশের বাংলায়, মুজিবের বাংলায়। সান্নিধ্য পেয়েছি এক অসামান্য প্রতিভার। স্নেহ প্রীতি ঋদ্ধ হয়েছি অনেক গুণীজনের।

আমার বয়স তখন ১২। আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। গাফ্ফার ভাই ঢাকা কলেজে পড়েন দ্বাদশ শ্রেণিতে। একুশের আকাশ বাতাস টিয়ারগ্যাস গুলি বরকত সালামের রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়া মগজ আমাদের দুজনকেই আচ্ছন্ন করেছিল। আমরা অভিভূত হয়েছিলাম।

গাফ্ফার চৌধুরীর অমর সৃজন, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” গান ঢাকা কলেজে গাওয়া হলো আবদুল লতিফের দেওয়া সুরে। গাফ্ফার ভাইয়ের ঘাড়ে নামল বহিষ্কারের খড়গ। তখন নাম শুনেছি তাঁর, কিন্তু দেখিনি। দেখা হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫।

আমি দেয়াল পত্রিকা বের করলাম। নামটা বিদঘুটে, ‘ঠুস ঠাস’। হুলস্থূল হলো। বেআইনি কাজ বলে জেলার অগ্নিশর্মা হয়ে নিজে হাতে ছিঁড়ে ফেললেন। পরের সংখ্যায় শীর্ষ শিরোনাম গাফ্ফার ভাই বলে দিলেন, “ঠুসঠাস চির অব্যাহত থাকবে”। সেবারও জেলার এসে ছিঁড়ে ফেললেন। তৃতীয় সংখ্যায় ছোট্ট করে কড়া একটা সম্পাদকীয় লিখে দিলেন গাফফার ভাই, “স্বৈরাচার নিপাত যাক”। জেল কর্তৃপক্ষের রক্তচোখ ও রোষ থেকে বাঁচালেন সহবন্দী জিল্লুর রহমান, শামসুজ্জোহা, এস এ বারি এটি ও আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ জ্যেষ্ঠরা।

দেয়াল পত্রিকা লিখে আমার হাতেখড়ি হলো। আমিও একজন ক্ষুদে সাংবাদিক হয়ে গেলাম। ছোটখাটো সম্পাদক। শতাধিক সহবন্দী। আমি সর্ব কনিষ্ঠ। সবাই কাছে ডাকলেন। প্রদেশের সবকটা ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ নেতা থেকে পাতি নেতা। ঢাবি সব হল এবং সবকটি কলেজের ভিপি জিএস। চিরুণি তল্লাশি দিয়ে ছেঁকে আনা হয়েছিল। আমাকে এনেছিল “আমি কি ভুলিতে পারি.....” গান গাওয়া রাজপথের আইনভাঙা ভোরের মিছিল থেকে। সবার কাছেই আদর আপ্যায়ন পেলাম। তারপর আরও অনেক কাণ্ড। গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। পাহাড়ের পাশে নুড়ি পাথর যেমন। তখনই কয়েকটা বই বেরিয়েছে তাঁর।

আমি ক্লাস টেনে পড়ি, গাফ্ফার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ। একমাস পর আমরা মুক্তি পেলাম। গাফ্ফার ভাই থাকতেন এফএইচ হলের পশ্চিম দিকের একতলায়। রুম নম্বর ১২। অনেকবার দেখা হয়েছে। তার পর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। আবার দেখা হলো পিআইএর বোয়িং বিমানে। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩, বোয়িং বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইটে লাহোর গেলাম পিআইএর মেহমান হয়ে।

গাফ্ফার ভাই স্বনামধন্য সাহিত্যিক, সাংবাদিক কলামিস্ট। অসামান্য গীতিকার ও কবি। আমি ইত্তেফাক কাগজের তুচ্ছ সাব এডিটার। বিমানে পাশাপাশি বসে কথা বলতে বলতে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। আগে অনেক বেশি সময় লাগত ডাকোটা বিমানে। কষ্টও হতো বেশ, শব্দ দূষণ ও ঘন ঘন বাম্পিঙে। বোয়িং বিমানে সফর সে তুলনায় আরামদায়ক। তার ওপর বিনা পয়সায় প্রমোদ ভ্রমণ। তার স্বাদই আলাদা। পিআইএর বিনোদনসহ মেহমানদারি ও আদর-আপ্যায়নের কোনো তুলনা হয় না। তখনো ইন্টার কন্টিনেন্টালের মতো কোনো পাঁচতারা হোটেল হয়নি। লাহোরের সবচেয়ে বিলাসবহুল নামিদামি পার্ক লাক্সারি হোটেলে তিন দিনের রাজকীয় জীবন ছিল স্বপ্নের মতো, মধুরেণ, রঙিন। ঢাকার সব পত্রিকা, বার্তা সংস্থা, রেডিও, পশ্চিম পাকিস্তান ও বিদেশি পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি, সংবাদ জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, সব মিলে আমরা প্রায় ৩০ জন। আনন্দ বিনোদনের সে কী উদার ও বর্ণাঢ্য আয়োজন! সবাই আমরা সেই বিলাসী পানাহার ও আপ্যায়ন উপভোগ করছি, নাক ডুবিয়ে কবজি চুবিয়ে। কিন্তু গাফ্ফার ভাই ও আরও দু-একজন সিনিয়র সাংবাদিককে তার মধ্যে দেখা গেল না। বন্ধুবান্ধব পত্রপত্রিকা ও রাজনৈতিক বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে তারা সময়টা কাজে লাগালেন। তিন দিন পর স্বর্গ থেকে বিদায়।

গাফ্ফার ভাই বললেন, ঐতিহাসিক শহর, এখানে দেখার আছে অনেক কিছু, চলো আমরা কয়েকদিন আরও থেকে তার পর বাড়ি ফিরি। এমন সুযোগ তো বার বার আসে না। ঢাকা ফেরার দুখানা টিকিট হাতে দিয়ে পিআইএ আমাদের আলবিদা জানাল। আমরা উঠলাম গিয়ে শিল্পী রউফের বাসায়। খ্যাতিমান শিল্পী, উচ্চপদে সরকারি চাকরি করেন। একটা বাড়ির তিন তালায় একাই থাকেন। পরিবার আনেনি। গাফ্ফার ভাইর ঘনিষ্ঠজন, আমার একান্তই পরিচিত।

কয়দিন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। শালিমার গার্ডেন, ৫৫ একর জমিজুড়ে জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধ ও সেই লাহোর ফোর্ট যেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো .....আমি কী ভুলিতে পারি” গান গেয়ে প্রভাত ফেরি করার দায়ে আমার সহকর্মী পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক, ছাত্রনেতা হাসান নাসিরকে চাবকে রক্তাক্ত করে লাশ বানিয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক সরকার। প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক লাহোর জাদুঘর, ১৬৭৩-এ নির্মিত আওরঙ্গজেবের ৫৫ হাজার মানুষের স্থান সঙ্কুলানযোগ্য বিশাল বাদশাহী মসজিদ, দর্শনীয় কত কী। কত প্রাচীন নিদর্শন, কত মাজার, কত স্থাপত্য। মুঘল আমলের বিখ্যাত নাচঘর, শুড়িখানা ও সম্ভ্রান্ত হীরামান্ডি বেশ্যালয়ও বাদ গেল না আমাদের পরিদর্শন ও পরিক্রমা থেকে।

একদিন দুপুরে সিভিল সার্ভিস একাডমিতে লাঞ্চ খেলাম অনেকের সঙ্গে। গাফ্ফার ভাইর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের আমন্ত্রণে ভুরিভোজ। অন্যদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল দৈর্ঘ্য প্রস্থে দেড় ফুট গোলাকার মেগা চাপাতি ও ফ্রি দই-পিয়াজ। দাম দুই আনা। বাড়তি চার আনা খরচ করলে এক পিরিচ দুম্বার মাংস পাওয়া যেত। পকেটে ছুচো ডাকতে শুরু করেছে। দুজনই তাই কৃচ্ছ্রসাধনে প্রবৃত্ত হলাম। দুবেলা রুটি পেয়াজ, কেবল রাতেই মাংস সংযোগে প্রাণ রক্ষা পেল। কম পয়সায় কমলা মাল্টা আঙুর আপেল নাশপাতি অবশ্য মিলতো দেদার। যখন তখন সুলভ ফলাহারে তাই কোনো কার্পণ্য ছিল না।

ঢাকা থেকে যখন বের হলাম তখন ভাবিনি যে, গোটা লাহোর চষে হাজার বছরের ইতিহাসের আনাচে-কানাচে হেঁটে বেড়াতে পারব। গাফফার ভাইর সঙ্গে দেখা হবে সেটাও ভাবিনি। গাফ্ফার ভাইর হাত ধরতে না পারলে সফর সার্থক হতো না। গাফ্ফার চৌধুরী রাজনীতিতে কখনো সক্রিয় হননি। মতাদর্শে ছিলেন সে সময় রেডিকাল। আরএসপি ভক্ত ছিলেন। তাঁর অন্তরস্থ সংগ্রামী চেতনাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল এমন অনন্য গান রচনায় যা আবেগে ভাসিয়ে দিল বিশ্ব বাঙালিকে। স্বদেশের গণমানসকে উদ্বেলিত করল, উদ্যাম সংগ্রামী গণচেতনা। ১১ মার্চ ‘৪৮ ভাষা সংগ্রাম, ৪৯-এর কৃষক বিদ্রোহ ৫০ সালে তেভাগা দাবিতে নাচোলে সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে গণহত্যা, ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে তেভাগা আন্দেলনের ৮ পথিকৃতের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং ৫২-এর রক্তধারা ১৯৫৪ সালের গণবিপ্লবের আবহ তৈরি করল।

’৫৪ সালের নীরব ব্যালট বিপ্লবের নেতা এ কে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা ছিল সবারই। কিন্তু ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিলেন ইসলাম বাঁচাবার কথা বলে, মনের ভিতর পাকিস্তান বাঁচিয়ে বড় পিঁড়ি পাওয়ার খায়েশ নিয়ে। আঁতাত করলেন ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হলেন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। গণতন্ত্রের মানসপুত্র অখণ্ড বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অতি-ডানে কাত হয়ে ও মওলানা ভাসানী অতি-বাম হয়ে আওয়ামী লীগ ভেঙে দিলেন ১৯৫৭ সালে। তা না হলে সামরিক শাসনও হয়তো হামলে পড়ত না। ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। অনেক ব্যাপারে ভিন্নমত থাকলেও এ ব্যাপারে আমাদের ঐকমত্য ছিল। ন্যাপ গঠন করে বামপন্থিরা কল্পিত ও কথিত কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছতে পারেনি, বরং টুকরো টুকরো হয়ে আত্মহননের পথে এগিয়েছে। এ ব্যাপারেও আমরা সহমত ছিলাম। ন্যাপ গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন সব গণসংগ্রামের পৃষ্ঠপোষক পাঞ্জাবের মার্কসবাদী ধনকুবের মিঞা ইফতেখার উদ্দিন। ঢাকার রাজপথে তিনি লাঞ্ছিত হলেন ৪ জুলাই ’৫৭ ন্যাপ সম্মেলনে গিয়ে। পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্তি মেজর ইসহাক ও তুখোড় আইনজীবী মিঞা মাহমুদুল হকও উপস্থিত ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান ও পশ্চিমের অন্য প্রগতিশীল নেতাদের সঙ্গে। রূপমহল হলে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে।

মিঞা ইফতেখার উদ্দীন “আমি কী ভুলিতে পারি আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানের রচয়িতা ও পত্রিকা সম্পাদক গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে মতবিনিময় করতে আগ্রহী হলেন।

পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে যত উথাল পাতাল ও তুলকালাম হয়েছে তার গোড়ায় পেশোয়ারের একটা বড় ভূমিকা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ফয়সালা করেছিল জিন্না সাহেবের সঙ্গে। “কাশ্মীর এনে দেবে তার বদলে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি হবে। পেশোয়ারে হবে মার্কিন বিমান ঘাঁটি রাশিয়ার ওপর নজরদারির জন্য।” জিন্নাহ তো পটল তুললেন না বলে কয়ে। লিয়াকত আলী রাজি হলেন না। পরিণতি, ১৬ অক্টোবর ৫০, রাওয়ালপিন্ডি সেনা সদরের ভিতর জনসভায় ভাষণ দেয়ার সময় গুলিতে লিয়াকত আলী খানের প্রাণসংহার। তার পরে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলেন পর্যায়ক্রমে খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী মিউজিক্যাল চেয়ারের ঢঙে। কিন্তু কেউ পেশোয়ার বিসর্জন দিলেন না। সবার পরে জেনেশুনে বিষ পান করলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র খ্যাত, অখণ্ড বাংলার সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রাজ্ঞ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সিংহের মতো গর্জন করলেন কাগমারি সম্মেলনে। ৪৮ থেকে বহু ত্যাগ সাধনায় গড়ে ওঠা প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যমঞ্চ আওয়ামী লীগ ভেঙে গেল তাসের ঘরের মতো। সোহরাওয়ার্দী গদি হারালেন ১৭ অক্টোবর ১৯৫৭। সামরিক শাসনের খড়গ নামল ৭ অক্টোবর ১৯৫৮। আমও গেল ছালাও গেল।

গাফ্ফার ভাই বললেন, এতদূর আসলাম যখন চলো পেশোয়ারটা দেখে আসি। রাওয়ালপিন্ডিও দেখা হয়ে যাবে একই যাত্রায়। আমিও রাজি। 
অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেল লাহোর রেলস্টেশনে। আমরা রেল কারে করে পিন্ডি যাব। টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ালাম। আমরা চাইলাম টিকিট। কিন্তু টিকিট না দিয়ে দুজন কর্মী বেরিয়ে এসে আমাদের আলিঙ্গন করলেন। তারপর ভিতরে নিয়ে বসালেন। চা কেক-বিস্কুট আনিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। তাদের আমরা বাঙালি বলে চিনিনি। কিন্তু তারা ঠিকই শনাক্ত করেছেন। এটা এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। দ্রুতগামী রেলকারে আমাদের দুজনেরই প্রথম সফর। নতুন যাত্রাপথেও একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটল। সামনের ও পেছনের যাত্রীদের ভিতর থেকে একাধিকবার চা-নাশতার সরবরাহ পেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে পড়লাম। বাঙালি স্বজনকে চিনতে দেরি করে না। মুহূর্তেই আপন করে নেয়। এখন অবশ্য সেই অযোধ্যাও নেই সেই রামও নেই।

আমি এই নতুন পথে সফর করছি গাফ্ফার ভাইর সৌজন্যে।। আমার পকেটে টান পড়ছে বুঝতে পেরে গাফ্ফার ভাই নিজেই সব খরচপাতি চালাচ্ছেন। কারাবন্দী জীবনের সখ্য কখনো মলিন হয় না। ফেব্রুয়ারি ‘৫৫র কারাসান্নিধ্যে যে প্রীতিবন্ধন রচিত হয়েছিল বয়সের পার্থক্য ছাপিয়ে তা এই কয়েকদিনের পুনর্মিলনে আরও গাঢ় হয়েছে।

গাফ্ফার ভাই লেখার জগতে ডুব মেরেছিলেন। এক সময় সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেন। আমি অকৃতি অধম ছাত্ররাজনীতির উত্তাল স্রোতে ভেসে এসে সাংবাদিকতার পেশাকেই জীবনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছি। জ্ঞানী ও মূর্খ একই তরীতে ভাসছি হৃদ্যিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। 
‘অন্যদেশ’ পত্রিকা ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর শেষ স্বপ্ন। বিশ্বমানের সেরা বাংলা কাগজ করতে চেয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার পদ অলঙ্কৃত করে। আমাকে সঙ্গে রেখেছিলেন তাঁর নগণ্য কর্মী হিসেবে। অভিভাবকহীন হয়ে গেলাম।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর সমান হতে কখনো পারিনি। সব সময় তাঁর পেছনে ছিলাম। জীবনের শেষলগ্নেও আমি তেমনি পেছনে পড়ে আছি। প্রিয় গাফ্ফার চৌধুরী মহাপ্রস্থানের পথে এগিয়ে গেলেন। তাঁর চিরশান্তি কামনা করি। 

পুনশ্চ : প্রথম কলকাতা লিখেছে : প্রয়াত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তিনি শুধু একজন গীতিকার ছিলেন না, ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং সাহিত্যিক। 

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি লিখে গিয়েছেন অসংখ্য উপন্যাস এবং স্মৃতিকথা। এ ছাড়াও ছোটদের উপন্যাস লেখক হিসেবেও তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৩০টি। এ ছাড়াও ‘পলাশী থেকে বাংলাদেশ’, ‘রক্তাক্ত আগস্ট’, ‘একজন তাহমিনা’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ নাটক লিখেছেন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে বরিশালে। মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার চৌধুরী বাড়ির সন্তান ছিলেন তিনি। নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন সাংবাদিক হিসেবে, তখন তিনি কাজ করতেন ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায়। তারপর ঠিক এক বছর পর তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’-এ অনুবাদক হিসেবে যুক্ত হন। এ ছাড়াও তিনি বহু পত্রিকায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন। শুধু বাংলাদেশে নয়, কলকাতায় যুগান্তর এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করেছেন কলামিস্ট হিসেবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সপরিবারে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তখনই কলকাতায় বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির কাজে যুক্ত হন। 
তিনি তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন প্রবাসী হিসেবে। ১৯৭৪ সালে পাড়ি দিয়েছিলেন লন্ডনে, যদিও তার পেছনে ছিল বিশেষ কারণ। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে গিয়েছিলেন, সেখানে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। ফেরার পথে তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যান, তারপর সেখান থেকে নিয়ে যান লন্ডনে। তারপর থেকেই তিনি লন্ডনে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি সারা জীবনে বহুমুখী প্রতিভা এবং কাজের জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। একুশে পদক, বঙ্গবন্ধু পদক, শেরেবাংলা পদক, বাংলা একাডেমি পদক প্রভৃতি পদকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন ইউনেস্কো পুরস্কার। 

লেখক : সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি
অন্যদেশ, নিউইয়র্ক। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর