৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ১০:২৮

আঁধারে জ্বলুক দীপ

মাহমুদ হাসান

আঁধারে জ্বলুক দীপ

পীর হাবিবুর রহমান

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রয়াত নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর নিজের ৫০তম জন্মদিনটি খুব ঘটা করে উদযাপন করেছিলেন। জন্মদিন উৎসবের আয়োজন করেছিলেন অভিজাত গুলশান ক্লাবে। সেই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম বিশিষ্ট কবি মাশুক চৌধুরীর সঙ্গে। আমাদের দুজনকে দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন পীর হাবিব। আমাদের অগ্রজ বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক মাশুক চৌধুরী (ভাই) ২০২০ সালে করোনায় মারা গেছেন। প্রিয়স্বজনের সেই শোক মুছতে না মুছতে ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চিরকালের জন্য চলে গেলেন অনুজপ্রতিম পীর হাবিবুর রহমান। তাকে তার বন্ধু-সহপাঠীরা হাবিব নামে ডাকলেও আমি সম্বোধন করতাম পীর।

পীর হাবিব তার ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে স্ব-উদ্যোগে বের করেছিলেন জীবনী সংকলন ‘আমার অর্ধেক জীবন’। সেখানে তাকে নিয়ে আমার একটা লেখা ছাপা হয়। সেই রচনার শিরোনাম ছিল ‘পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ’। এটি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীথিকা’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার নাম। ওই কবিতার প্রধান চরিত্র রোঘো, রঘু ডাকাত। দস্যু রঘু ত্রাস, আবার ত্রাতাও। সমাজের শীর্ষদেশের চোখে রঘু ধন-সম্পদ লুণ্ঠনকারী এক ভয়ংকর ডাকাত। আর সমাজের তৃণমূলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কিংবা ঋণে জর্জরিত কৃষক, তাদের কাছে রঘু কেবলই ত্রাণকর্তা।

সাংবাদিক-কলামিস্ট পীর হাবিবুর রহমানকে ‘রঘু ডাকাত’ জ্ঞান করে এ রচনা তৈরি করেছিলাম আমি। পীর হাবিবের রাজনৈতিক ভাষ্য, সমকালীন বিষয়ে মন্তব্য প্রতিবেদন কিংবা উপসম্পাদকীয় কলাম সম্পর্কে পাঠকের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখে-শুনে আমার সেই রোঘোর কথাই মনে পড়েছে বারবার। রোঘোকে কেউ ভয় করে, আবার কেউ-বা তার সাহায্য পাওয়ার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। তেমনি পীর হাবিবের রচনাকেও। তার রচনায় অনুসন্ধিৎসু পাঠকের খোরাক থাকতো। থাকতো লক্ষ প্রাণের বাসনা। সেই বাসনা দেশের ভালো নিয়ে। দেশবাসীর কল্যাণ নিয়ে। তিনি আমৃত্যু চেয়েছেন সম্মুখসারিদের মনুষ্যত্ব জাগ্রত হোক।

সত্য কথাটা সোজাসাপটা বলার জন্য, গোপন বিষয়টা রাখঢাক না করার জন্য পীর হাবিব বেশিরভাগ পাঠকের প্রিয়জন হয়েছিলেন, আবার অনেকের বিরাগভাজনও। এখানেই একজন সাংবাদিকের সার্থকতা। একই রচনার জন্য একজন কলামিস্ট একপক্ষের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন, আবার অন্যপক্ষের সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছেন। ঠোঁট-কাটা পীর হাবিবের বড় গুণ ছিল তিনি যা বিশ্বাস করতেন সেটাই লিখতেন এবং বলতেন। সুবিধাবাদীদের মতো মেঘ দেখে ছাতা ফোটাতেন না। অনেকের মতো সময়-সুযোগ বুঝে ভোল পাল্টাননি কখনো। প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন। আখের গোছানোর চেষ্টায় জলাঞ্জলি দেননি নিজের বিশ্বাসকে। মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে দেশের সাংবাদিকতা ভুবনে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন পীর হাবিব।

পীর হাবিবুর রহমান নিজগুণে ঈর্ষা ও সমালোচনার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতেন খুব দৃঢ়তার সঙ্গে। লিখতেন হাত খুলে, আর টক শো-তে কথা বলতেন স্পষ্টকণ্ঠে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে উন্মোচনের চেষ্টা করতেন জাতির আকাঙ্ক্ষাগুলো। একজন তারকা কলামিস্ট হিসেবে একটা ভক্তগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তার। এ ভক্তদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, জিয়াউর রহমানকেও। অতীতমুখিনতা নয়, সামনে এগিয়ে চলাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। কে দেশের স্বার্থ রাখছে, আর কে বিকোচ্ছে সে-ব্যাপারে আগাগোড়া খোঁজ-খবর রাখে তারা। পীর হাবিব ডিজিটাল জামানার এই তরুণদের চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দগুলো তার লেখায় দরদ দিয়ে আকীর্ণ করতেন। এ জন্যই তিনি নবীনদের প্রিয়জন হয়ে ছিলেন।

পীরের কলমই সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আপসহীন ছিল তার রাজনৈতিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা। তারপরও দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থে তার প্রিয় নেতা-নেত্রীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসতেন তিনি। তার লেখায় বক্তব্য নিয়ে মতান্তর থাকতে পারে, তবে কোন ধোঁয়াশা রাখতেন না তিনি। যা বিশ্বাস করতেন সেটাই লিখতেন, বলতেন। কোন রাখ-ঢাক রাখতেন না, তা যতই অপ্রিয় হোক। পীর হাবিব ছিলেন একটু বেশি আবেগপ্রবণ, সেইসঙ্গে অভিমানী। পীরের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল তার আবেগ এবং সবচেয়ে বড় বন্ধুও ছিল তার আবেগ। এ আবেগ থেকেই তার মেধা ও মননে সৃষ্টি হয়েছে দেশের প্রতি আনুগত্য, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম। 

দেশকালপাত্র নিয়ে, ক্ষমতার অন্দর মহলের বিভিন্ন নীতি-পদক্ষেপ নিয়ে, বিরোধী দলের অন্ধ বিরোধিতা নিয়ে, রাজনৈতিক দস্যুতা নিয়ে পীর হাবিবের সমালোচনামূলক অভিমতগুলো ছিল নিঃসন্দেহে একজন সচেতন সাহসী সাংবাদিকের দায়বদ্ধতাপ্রসূত হৃদয়ের আকুতি। যারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভীষ্ট এখনও অর্জিত হয়নি, গণতন্ত্রের শাখা বিস্তারের পথ এখনও বন্ধুর, তাদের সঙ্গেই আমৃত্যু ছিলেন পীর হাবিবুর রহমান। ছিলেন ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অনড়-অটল, সহজে দমবার নন, যেমন সহজে নেভে না পিলসুজের উপর পিতলের প্রদীপ। ঘন আঁধার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তার তীক্ষ্ণ আলো। প্রিয় পীর হাবিবের অর্ধেক জীবন এপারে আলোয় ভরা, বাকি অর্ধেক জীবন ওপারে দীপ হয়ে জ্বলুক।

লেখক : উপসম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর