শুক্রবার রাত প্রায় দুইটা। অকল্যান্ডের একটি বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে আরও দুইটা ট্যাক্সি ক্যাব। বার বন্ধ হতে তখনও প্রায় আধা ঘণ্টা বাকী। হঠাৎ বারের সুঠামদেহী বাউন্সার একটি স্থুলকায় মাতাল তরুণীকে সামনের ট্যাক্সি দুটোকে ডিঙ্গিয়ে এক রকম জোর করে আমার গাড়ীতে তুলে দিলো।
মেয়েটি গাড়ীতে উঠেই বাউন্সারের চৌদ্দ গুষ্ঠি তুলে গালাগালি শুরু করে দিলো। আমি কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করাতে আরও রেগে গিয়ে বলল, গো টু হেল।
আমি নর্থ মোটরওয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছি আর ভিউ মিররে মেয়েটাকে দেখছি। মেয়েটা ঝিম ধরে বসে আছে। আমি বুঝলাম অবস্থা বেগতিক। সে এখন হয় ঘুমিয়ে পড়বে অথবা গাড়ীর ভেতরেই বমি করে দিবে। আমি ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম।
তোমার দিন আজ বুঝি খুব খারাপ গেছে তাইনা? মেয়েটির ভিতর কোন ভাবান্তর দেখলাম না। কিছুক্ষণ পরে বলল, তোমার কাছে সিগারেট আছে? মনে হলো সিগারেট পেলে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়বে না কিংবা তার বমি চাপিয়ে রাখার মেয়াদ দীর্ঘায়িত হবে।
আমি সিগারেট খাইনা। হঠাৎ মনে হল গতকাল একজন অর্ধেক প্যাকেট বেন্সন এন্ড হেজাস সিগারেট ফেলে গেছে। আমি বললাম, তুমি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খাও? মেয়েটি বিড়বিড় করে কি বলল বুঝতে পারলাম না। ও আমার কাছ থেকে প্যাকেট নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে জানালার গ্লাস সামান্য নীচে নামিয়ে দিলো।
কিছুক্ষন পরে সে কান্নার সাথে হিকাব তোলা শুরু করলো। ভাবলাম এইবার সম্ভবত সে গাড়ীতেই বমি করে দিবে। আর তা করলে আজ আমার রাতটাই মাটি। বমি পরিস্কার করা ছাড়াও গাড়ীতে গন্ধে কোন প্যাসেঞ্জার উঠবে না।
আমি তাড়াতাড়ি মোটরওয়ে থেকে গ্লেনফিল্ডে এক্সিট নিয়েই একটি পার্কের সামনে গাড়ি থামালাম। পিছনের দরজা খুলে মেয়েটিকে ইশারায় নেমে আসতে বললাম। সে ভীত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি নির্ভয় দিয়ে বললাম, না না আমি তোমাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাবো না। এসো, আমরা সামনের বেঞ্চিতে বসে কিছুক্ষণ গল্প করি। তারপর তাকে আরও বিশ্বাস করানোর জন্য বললাম, আসলে সেই দুপুর থেকে ড্রাইভ করছি। আমারও খুব ক্লান্ত লাগছে।
তরুণী এবার আমার কথা কিছুটা বিশ্বাস করে তার হাত এগিয়ে দিলো। আমি তাকে ধরে গাড়ি থেকে নামালাম। সাথে পানির বোতল নিয়ে তাকে পার্কের বেঞ্চি পর্যন্ত হেঁটে যেতে সাহায্য করলাম।
সে বেঞ্চিতে ঝিম মেরে বসে থাকার কিছুক্ষণের মধ্যেই হরহর করে বমি করলো। আমার কাছ থেকে পানির বোতল চেয়ে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিলো।
তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আমার নাম কাইলি স্মিথ। আমি আমার নাম বলে করমর্দন করলাম।
আমি আসলে আজ তোমার অনেক সময় নষ্ট করে ফেললাম। আমি ভদ্রতা করে বললাম, না ঠিক আছে।
কাইলি জানালো, গত দুই বছর আগে ওর মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তাই সে স্কুল শেষ করেই একটা জব শুরু করে। মা মেয়ের ভালই দিন কাটছিল। কিন্তু বছরখানেক ধরে তার মা একজন ব্রিটিশ বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছে।
সে তার মার বয় ফ্রেন্ডকে একদম সহ্য করতে পারে না। কারণ তার মা বাসায় না থাকলে সে তার সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ খোঁজে। এ ব্যাপারে মাকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। বরং মা তার বয়ফ্রেন্ডের কথা শুনে তাকে অবিশ্বাস করে গালিগালাজ করে।
আমি বললাম, তোমার নিজের কোন বয়ফ্রেন্ড নাই? মেয়েটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই মোটা মেয়ের সাথে কোন ছেলেই বেশীদিন থাকতে চায়না। আমি যা আয় করি তার সবটুকুই ছেলেদের পিছনে খরচ করি। আমার পয়সায় মদ খেয়ে পরদিন কেউ আমার ফোন রিসিভ করে না।
আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই। মেয়েটি আমার হাত ধরে বলল, তুমি আমাকে বরং এখানে রেখেই চলে যাও। আমার ব্যাগে কিংবা কার্ডে কোন ডলার নেই। আমি এখান থেকে বড় রাস্তায় উঠে লিফট চেয়ে বাসায় চলে যাবো।
আমি তাকে বাসায় নামিয়ে দিলাম। তার অনুরোধে আমার মোবাইল ও গাড়ীর নম্বর দিয়ে চলে এলাম।
কাইলিকে প্রায় ভুলেই গেছিলাম। সপ্তাহ দুয়েক পরে ট্যাক্সি অফিস থেকে রেডিওতে আমাকে জানালো, কাইলি নামের একটি মেয়ে কিছু ফুল ও একটি খাম আমার জন্য রেখে গেছে।
লেখক: সিডনি প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন