হেদায়াতুল কবির সুমন, ২০০৯ সালে ব্রিটেনে আসেন একটি কলেজে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে। ২০১১ সালে তিনি ভিসা বাড়ানোর জন্য হোয়াইটচ্যাপেল টোটাল কেয়ার নামের একটি স্টুডেন্ট কন্সালটেন্সি ফার্মে তার অরিজিনাল সব সার্টিফিকেটসহ সাড়ে ৩ হাজার পাউন্ড জমা দেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। এই একটি সিদ্ধান্তই বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে হেদায়তুলের জীবন। ভুক্তভোগী হেদায়াতুল কবির সুমন বলেন, টোটাল কেয়ার নামক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হওয়ার কারণে আমার টাকা গেল, সার্টিফিকেট গেল, আমাকে টোয়েক অপরাধী বানালো, এক কথায় আমার জীবন ধ্বংস করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
হেদায়তুলের মতো বিভিন্ন দেশের শত শত ছাত্র-ছাত্রী আজকে টোটাল কেয়ার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার হয়ে প্রায় অনিশ্চিত জীবনের মুখে দিন কাটাচ্ছে ব্রিটেনে। অনেকেই বাংলাদেশেসহ নিজ দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অন্যতম স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই যুক্তরাজ্যে এসেই অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের স্বপ্নের মৃত্যুকে দেখছে টোটাল কেয়ারের মতো প্রতারক স্টুডেন্ট কন্সালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের জন্য। কারণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আশ্বাসে আসা শিক্ষার্থীদের প্রতারণা জালে আটকে নিঃস্ব করে দিয়েছে এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান।
টোটাল কেয়ার লন্ডন নামে এই এজেন্সিটির অফিস পূর্ব লন্ডনের ব্যস্ততম এলাকা হোয়াইটচ্যাপলে। স্টুডেন্ট এজেন্সি সার্ভিস টোটাল কেয়ার লন্ডন, ব্রিটেনে আগত বিভিন্ন দেশি- বিশেষ করে অনেক বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তৈরি করেছিলো স্টুডেন্ট সার্ভিস প্যাকেজ।
এই এজেন্সির কাজ ছিলো মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া। তাছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন কোর্স সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে সঠিক বিষয় বেছে নিতে সহযোগিতা করতো এই এজেন্সি। কিন্তু এই অফিসকে ঘিরেই তৈরি হয়েছিলো বিশাল প্রতারক চক্র। যে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থীরা খুইয়েছেন লক্ষ লক্ষ পাউন্ড।
এই ঘটনাটি প্রথম ব্রিটিশ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসে ২০১৪ সালে বিবিসি প্যানারোমাতে গোপন ক্যামরায় ধারণ করা ফুটেজে। সেখানে দেখা যায় কিভাবে ইংরেজি স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষায় জালিয়াতি করা হচ্ছিলো। বিবিসি প্যানারোমার তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৮০০ ছাত্রের জন্য বোগাস পরীক্ষার আয়োজন করেছিলো প্রতিষ্ঠানটি!
এই প্রতিষ্ঠানটির দুই পরিচালক হচ্ছেন বাংলাদেশি তালাল চৌধুরী ও শাহীন আহমেদ। এদেরকে তখনই গ্রেফতার করা হয়। তালাল চোধুরী ও শাহীন আহমেদ, চৌধুরী বাকের হাবিবসহ এই গ্যাংয়ের অনেকেই বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে ব্রিটেনে। এদের মধ্যে কিছু ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকও রয়েছেন ।
ব্রিটেনের অভিবাসন আইন অনুযায়ী দণ্ডপ্রাপ্তরা যদি ব্রিটিশ নাগরিক না হয়ে থাকেন, তবে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে তাদেরকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে ব্রিটিশ সরকার। তাই তালাল চৌধুরী ও শাহীন আহমেদকে ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে কি না বা এটা প্রক্রিয়াধীন আছে কি না এ সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগী বিভিন্ন ছাত্রদের অভিযোগের ভিত্তিতে তালাল চৌধুরী ও শাহীন আহমেদের চালু করা স্টুডেন্ট এজেন্সি সার্ভিস টোটাল কেয়ার লন্ডন এর হোয়াইট চ্যাপেলের অফিসটিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সেই অফিস তালা মারা, তবে পাশের অফিসের সাথে কথা বলে জানা যায় সেখানে এখনও হন্য হয়ে ঘুরছে অনেক শিক্ষার্থী। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ এখানে টাকার জন্য বা তাদের কাগজপত্র ইত্যাদির জন্য ধর্না দেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, ব্রিটিশ আইন শৃংখলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে হঠাৎ বন্ধ হওয়ায় তাদের অনেকেই টোটাল কেয়ারকে দেয়া তাদের অর্থ ফেরত পাননি অথবা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেননি। ফলে অনেকেই অবৈধ হবার কারণে ও বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটেন ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হবার পাশাপাশি এরা হারিয়েছেন জীবনের মূল্যবান সময়ও। অনেকেরই ক্ষতি পূরণ হবার মত নয়।
টোটাল কেয়ার এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়ে বাংলাদেশে ফেরত যাওয়া আবু তাহের বলেন, আমি শুনেছি ওই দুই ব্যক্তি আসলে ব্রিটেনের কারাগারের শাস্তি মেয়াদ শেষ করে বাংলাদেশে লুকিয়ে আছেন। তারা যেখানেই থাকুক আমাদের টাকা পয়সা ফেরত দিতে হবে। তা না হলে মামলা-হামলা করে হলেও আমরা টাকা উদ্ধার করবো। তিনি মনে করেন, এধরনের মানুষ বাংলাদেশের জন্যও খুব বিপজ্জনক! বাংলাদেশ সরকারের উচিত এদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক