১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৩:১৭

প্রবাসী বর

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী

 প্রবাসী বর

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী

এক.

নতুন শহর। নতুন পরিবেশ। অচেনা সব মানুষ। তাই বাসা থেকে বের হয়না আবির। সকালে থেকে বিকাল পর্যন্ত অফিস। তারপর আবার বাসা। এক সপ্তাহ আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসেছে সে। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যে আবির মানসিক রোগী হয়ে যাবে তার বুঝতে বাকি নেই। তাই সে পরিচিত বড় ভাই ফাহাদকে ফোন দিলো। ফাহাদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন। 

ভাই আমি চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে এসেছি। শহরে পরিচিত আমার কেউ নেই। বলতে গেলে গৃহবন্ধী জীবন কাটাচ্ছি। 
তুমি চট্টগ্রামে গেলা কবে? আমাকে তো কিছুই জানাও নি?

আসলে ছোটখাটো চাকরি নিয়ে এসেছি। তাই লজ্জায় আর ফোন করেনি। ঘরে বসে সময় কাটাতে আর ভালো লাগছে না। ঘুরাফেরার মতো কয়েকটা জায়গার নাম বলেন ভাই।

প্রেমিকাসহ যাবে? নাকি সিঙ্গেল? হাস্য-রসাত্মকভাবে বললেন ফাহাদ।
ভাই প্রেমিকা থাকলে কী আপনাকে ফোন দিতাম! 

চট্টগ্রাম হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। একা ঘুরে মজা পাবে না। 
বন্ধু-বান্ধবী পাবো কোথায়? সময় কাটাতে পারি এমন জায়গা হলেই আপাতত চলবে।

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের পাশে বাতিঘর নামে একটা বড় লাইব্রেরী আছে। সেখানে প্রতিদিন সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি লেখক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষজন আসেন। সেখানে তুমি যেতে পারো। পড়াও হবে, বন্ধু বান্ধবীও জুটে যাবে। 

অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই। আগামীকাল অফিস শেষে ঘুরে আসবো একবার। আজ তাহলে রাখি।
ঠিক আছে। কোন প্রয়োজন হলে কল দিও। এই বলে ফোন রেখে দিলে ফাহাদ।

দুই.

পরের দিন অফিস শেষে বাতিঘরে গেল আবির। বিভিন্ন সেলফে সারিবদ্ধভাবে সাজানো বই দেখে আবিরের মন ভরে গেল। সে মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে বই দেখছে। পছন্দের বই খুঁজতে লাইব্রেরিতে কয়েক চক্কর দেয়া হয়ে গেল। এসময় একটা কাকতালীয় বিষয়ও ঘটল। আবির যে সেলফের বই হাতে নেয় সেখানে একটা মেয়ের সাথে দেখা হয়। এভাবে বেশ কয়েকবার মেয়েটির চোখে চোখ পড়ায় আবির কিছুটা বিব্রত বোধ করলো। তাই সে আর নতুন বইয়ের সন্ধান না করে আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাস নিয়ে পড়তে বসলো। আবার ঘটলো মজার ঘটনা। সেই অচেনা মেয়েটিও বই নিয়ে আবিরের মুখোমুখী বসলো। বই পড়ার ফাঁকে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো। আবির অস্বস্তি বোধ করছে। তাই সে ভাবালে মেয়েটির সাথে পরিচিত হওয়াই ভালো। আবির সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি নিয়মিত এখানে আসেন?

হঠাৎ এমন প্রশ্নে মেয়েটিও কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। 

সে মুচকি হেসে বললো, সুযোগ পেলেই আসি। আপনি?
আজ প্রথম এলাম। শহরে নতুন এসেছি। কোন কিছু চেনাজানা নাই। তাই আগে আসা হয়নি। 
এখানে আসলে বই পড়ার পাশাপাশি অনেকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। শহরও চেনা হয়ে যাবে সে সুবাদে। 
আবির বলল, কিছু মনে না করলে চলেন কফি খেতে খেতে গল্প করি। বই তো অনেকক্ষণ পড়া হলো। 
মেয়েটি প্রথমে মানা করলো। পরে ভদ্রতার খাতিরে সম্মতি জ্ঞাপন করল।

আবির কফি কর্ণার থেকে দু‘কাপ কফি নিল। পাশেই একটা টেবিল ফাঁকা ছিল। আবির আর মেয়েটি সেখানে গিয়ে বসল। কফিতে চুমুক দিতে দিতে দু‘জন পরিচিত হয়ে নিল।
মেয়েটির নাম অধরা। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে। 
কফি খাওয়া শেষে আবির বললো, রাততো প্রায় আটটা বেজে গেছে। বাসায় ফিরবেন না?
হ্যাঁ। এখনি ফিরতে হবে। না হয় বাসায় চিন্তা করবে। 

আমাকেও যেতে হবে। আশা করি আবার দেখা হবে। এই বলে দু‘জনই বের হয়ে নিজ নিজ বাসার দিকে চলে গেল।

তিন.

আবির এখন অফিস শেষ করেই প্রায় প্রতিদিন চলে যায় লাইব্রেরিতে। নতুন নতুন বই পড়া আর অধরার সাথে আড্ডায় ভালো সময় কাটছে তার। কয়েক মাসের ব্যবধানে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়। সম্মোধনও আপনি থেকে তুমি হয়ে গেলো।

একদিন শুক্রবার সকালে অধরা হঠাৎ ফোন করে বললো, আজ লাইব্রেরিতে যাবে না কিন্তু। তোমাকে শহর চেনাবো। তিনটার দিকে জিইসির মোড়ে চলে আসবে। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো। 

আবির কোনো আপত্তি করল না। তাদের প্রেম এতোদিন লাইব্রেরিতেই সীমাবন্ধ ছিল। আজ প্রথম তারা কোথাও ঘুরতে যাবে। বিকালে জিইসির মোড়ে গেল আবির। গিয়ে দেখলো অধরা তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। 
অধরাকে দেখেই আবির বলল, কোথায় নিয়ে যাবে?

তোমাকে এতো কিছু জানতে হবে না। চলো আমার সাথে। 

অধরা একটা টেক্সি নিয়ে আবিরকে উঠতে বলল। আবির এই প্রথম অধরার এতো কাছিকাছি বসেছে। অধরাকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ সুন্দর লাগছে। লাল শাড়ির সাথে মিল করে লাল টিপ, লিপস্টিক, কানের দোল এবং হাতের রেশমি চুুড়িতে অধরার সৌন্দর্য নিপুনভাবে ফুটে উঠেছে। আবিরের কাছে মনে হচ্ছে নতুন এক অধরা তার পাশে বসে আছে। কলি থেকে ফুল ফুটলে যেমন তার সৌন্দর্য বিকশিত হয় ঠিক তেমনি। ফারফিউম আর অধরার শরীরের ঘ্রাণ দুটো একসাথে মিশে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আবিরের ইচ্ছে করেই অধরার গা ঘেষে বসলো। তারপর চোখ চোখ বন্ধ করে সে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিচ্ছিল। 

তোমাকে ভাটিয়ারি নিয়ে যাচ্ছি। আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজন সেখানে সময় কাটাব। অধরা কথায় ঘোর কাটল আবিরের। 
আমি লোকেশন প্রতিবন্ধী। তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাও আমি চোখ বন্ধ করে সেখানেই যাবো। 
প্রথমে বড় রাস্তা তারপর কিছুটা আকাঁ বাঁকা পথ পেরিয়ে তারা এসে পৌছাল ভাটিয়ারিতে। 
আবির টেক্সির ভাড়া দিয়ে অধরার পিছু পিছু হাঁটলো। অধরা তাকে নিয়ে ক্যাফে টোয়েন্টিফোর রেস্টুরেন্টে বসল। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেল।


দুজন মুখোমুখি বসা। আবির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে।
এই তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? আমার কিন্তু লজ্জা লাগছে?
আসলে কখনও তোমাকে এমন করে দেখা হয়নি। তাই মন ভরে দেখি নিচ্ছি।


দু‘জনের চোখের পানি টলমল করছে। কাছে পাওয়ার আকুতি চোখের ভাষায় স্পষ্ট ফোটে উঠেছে। ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলো। আবির আর অধরা একটু নড়েচড়ে বসলো। নিজেদের আবেগ সামলে নিয়ে তারা খাবার খেতে শুরু করলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। চলো এখান থেকে তোমাকে সানসেট পয়েন্টে নিয়ে যাই। সেখানে বসে কফি খেতে খেতে সূযাস্ত দেখবো। বললো অধরা।
ঠিক আছে চল।
আবির রেস্টুরেন্টের বিল পরিশোধ করে সেখান থেকে রাস্তায় আসলো। তারপর একটা টেক্সি নিয়ে দু‘জন চলে গেল সানসেট পয়েন্টে। দূরের আকাশে লাল টুকটুক সূর্য।
আবির বললো, ক্ষমতা থাকলে দূরের সূর্যটাকে এনে তোমার কপালে টিপ পরিয়ে দিতাম। 
আর চাপা মারতে হবে না। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখো। হেসে বললো অধরা।
পশ্চিম দিগন্তে সূর্য লাল বর্ণের আলোক জ্যোতি ছড়িয়ে সবুজ পাহাড়ের আড়ালে ধীরে ধীরে লুকিয়ে গেল। এ অপরূপ দৃশ্য দুজকে বিমোহিত করলো। 
সানসেট পয়েন্টের থেকে বের হয়ে তারা টেক্সি নিলো বড়দিঘির পাড় পর্যন্ত। সেখান থেকে বাস বা টেক্সিতে চড়ে ফিরতে হবে জিইসিতে।
তখন প্রায় সন্ধ্যা। রাস্তা বেশ ফাঁকা। উচু নিচু পাহাড়ি রাস্তায় চলছে টেক্সি। টেক্সি যখন রাস্তার বাঁক নিচ্ছে তখন একজনের শরীর হেলে আরেকজনের সাথে মিশে যাচ্ছে। এতে দু‘জনেই শিহরিত হয়ে উঠছে। হঠাৎ আবির বললো, তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব। 
অধরা সম্মতি থাকার পরও বললো, টেক্সি চালক বা রাস্তার লোক দেখলে কি ভাববে?
যা ভাবার ভাবুক। এই বলে আবির অধরাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষন পর নিজেদের অজান্তেই একে অপরকে চুমু খেলো। শিহরণ আর উত্তেজনায় দু‘জনের শরীর কাপছে। আবিরের কপালে হালাকা ঘাম দিয়েছে। আর অধরা কোন কথাই বলতে পারছে না। সে শক্ত করে আবিরের হাত ধরে বসে আছে। 
স্বল্প দূরত্বের রাস্তা। চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেল ভাটিয়ারির পথটুকু। আবির ভাড়া মিটিয়ে নতুন টেক্সি নিল জিএসসির উদ্দেশ্যে। আবার পথ চলা শুরু। রাস্তায় প্রচুর যানবাহন। তাই তারা চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইলো। 
আবির আক্ষেপ করে বললো, এটাই হয়তো তোমাকে শেষবারের মতো কাছে পাওয়া। 
কেন এমন মনে হলো তোমার?
সুন্দরী মেয়েদের দ্রুত বিয়ে হয়ে যায়। দেখা গলে কয়েকদিনের মধ্যে তোমার বিয়ে হয়ে যাবে। তুমি আমাকে ভুলে গিয়ে নতুন সংসারে মনোযোগী হবে। 
আমি মোটেও এমন মেয়ে না। এই বলে আবিরের হাতে হাত রেখে অধরা বললো, আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। পড়াশোনা শেষ না করে আমি বিয়ে করছি না। আর করতে হলে তোমাকেই করবো।
সকল বিশ্বাসের মধ্যেই অবিশ্বাস লুকিয়ে থাকে। অবিশ্বাস অনেকটা ভাইরাসের মতো। ভাইরাস বাসা বাঁধে শরীরে। আর অবিশ্বাস মনে। দুটোই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে খোলস পাল্টায়। তখন পরিণতি ভয়াবয়। 
এসব ফালতু কথা রাখো। আমরা সামনের মাসে রাঙামাটি যাবো। সেখানে নীরবে সময় কাটাব।
আবির মুচকি হেসে বলল, তোমার নাম যেমন অধরা, তুমিও অধরাই থাকবে।
দু‘জনের কথোপকথনে টেক্সি চলে আসলো জিইসিতে। টেক্সি থেকে নেমে আবির ভাড়া মিটিয়ে দিল। 
অধরা বললো, আর দেরি করা যাবে না। না হলে বাসায় হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হবে।
আমার যেতে মন চাচ্ছে না। তবু যেতে হবে। এই বলে অধরাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আবির চলে আসলো নিজ বাসায়।

চার.

রাতে ইতালি থেকে আবিরের বন্ধু ফাহিম ফোন দিয়ে বলল, আমি সামনের মাসে দেশে আসতেছি। বেশ কয়েকদিন থাকবো। 
এটা তো ভালো খবর। তবে হঠাৎ দেশে আসতেছিস। কোন সমস্যা নাকি?
ফাহিম হেসে বলল, সমস্যা চিরস্থায়ী করতে আসতেছি। তুই তো সমস্যাহীন জীবন পছন্দ করিস। 
কথা শুনে তো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ঘটনা কী বল।
ভাবছি এবার আসলে বিয়ে করবো। বয়স তো কম হলো না।
এতো বিদেশী পাত্রের ভীড়ে দেশি পাত্রের কোন মূল্য নেই। এখন তোদেরই সময়।
তোর সাথে কথা বলে পেড়ে উঠা কঠিন। আমি পরাজয় মেনে নিলাম। তবে কথা হলো তুই যতোই ব্যস্ত থাকিস না কেন বিয়েতে কিন্তু আসতে হবে।
চিন্তার কারণ নেই। আমি থাকব।

পাঁচ. 

কয়েকদিন ধরে অধারার সাথে আবিরের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। সামান্য বিষয় নিয়ে আবিরের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয় অধরা। আর অফিসের কাজের চাপ বেশি থাকায় সে অধরার সাথে দেখা করতে যেতে পারে না। মোবাইল ফোনে যোগাযোগই এখন আবিরের একমাত্র ভরাস। কিন্তু সেখানেও ঝামেলা। রাধে অধরার ফোন ওয়েটিং থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপেক্ষায় থাকে আবির। তারপর অধরা কল ব্যাক করে নানা অজুহতা দেখায়। তৃতীয় পক্ষের আগমন ঘটেছে বুঝতে পেরেও আবির চুপ থাকে। কিন্তু এভাবেই দিন দিন তাদের সম্পর্কেও অবনতি হতে থাকে। রাতভর সজাগ থেকেও আবির কথা বলার সুযোগ পায় না। আবির ভাবলো বিষয়টার সমাধান প্রয়োজন। একদিন রাতে দীর্ঘ সময় ওয়েটিং পেয়ে সে কড়া ভাষায় অধরাকে এসএমএস পাঠায়। অধরা অন্য একটা নম্বর থেকে আবিরকে ফোন দিয়ে বললো, তোমার সমস্যা কি? বারবার ওয়েটিং দেখেও ফোন দাও কেন?

আবির রাগান্বিত হয়ে বললো, ফোন দেয়ার অধিকার নেই নাকি আমার?
আমি তা বলছি না। কিন্তু তোমার কমনসেন্স থাকলে বার বার ফোন দিতে না।  বিদেশে আমার আত্মীয়-স্বজন থাকে। রাতে তারা ফোন দেয়। আর তুমি তখন এক প্রকার বিরক্ত করো।
এতোদিন তোমার আত্মীয়-স্বজন কোথায় ছিল? তাদের কথা আমাকে কোনদিন বলো নি কেন?
তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য না। আর সব কথা তোমাকে বলতে হবে কেন? খুব বিরক্তির সাথে বললো অধরা।
পাশ থেকে আবার ফোনের রিংটোন বেজে উঠল।
তোমার সাথে অহেতুক কথা বলার এখন সময় নাই। এই বলে হুট করেই ফোন কেটে দিল অধরা।
আবির অধরার নম্বরে আবার কল দিয়ে ওয়েটিং পেল। এভাবে প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত পাগলের মতো চেষ্টা করে গেল। প্রতিবারই একি ঘটনা। শেষে ফোন বন্ধ। আর কোন কথা বলার সুযোগ পেল না আবির।
সপ্তাহ খানেক ধরে একি ঘটনা চলছে। মাঝে মাঝে সকালের দিকে অধরা ফোন ধরলেও এক মিনিটের বেশি কথা বলে না। উল্টো ঘুম ভাঙানোর অভিযোগ করে খারাপ আচরণ করে। 
আরেকদিন রাতে অপরিচিত নম্বর থেকে আবার ফোন আসে আবিরের মোবাইল ফোনে। সে রিসিভ করতেই অধরা বলে, আমাদের সম্পর্কের বিষয়টা বাবা জেনে গেছেন। 
মানে কী? 
ভুলে বাবার রুমে ফোন রেখে এসেছিলাম। তিনি ম্যাসেঞ্জারের সব ম্যাসেজ পড়েছেন। বাবা চান না তোমার সাথে সম্পর্ক রাখি। আমিও আমার পরিবারকে কষ্ট দিতে চাই না। তোমার সব নম্বর এবং ম্যাসেঞ্জার ব্লক করে দিলাম।
তা দিলা। কিন্তু মন ব্লক করতে পারবা?
এসব সস্তা আবেগী কথা বলে আমাকে ইমোওশনালী ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করো না। আর বখাটে পোলাপানের মতো বিরক্ত করবা না ফোনে। আমি তোমার সাথে কোন বিষয়েই কমিটেড না। বাবা-মা’র পছন্দের পাত্রকেই আমি বিয়ে করবো। তোমার সাথে ফাও কথা বলার সময় নাই। রাখলাম। ন্যূনতম লজ্জা থাকলে যোগাযোগের চেষ্টা করবা না। এই বলে ফোন কেটে দিল অধরা।
তারপর থেকেই অধরার মোবইল নম্বর বন্ধ। আবির বেশ কয়েকদিন কল দিয়েও তাকে পায়নি। বলতে গেলে হঠাৎ করে নাই হয়ে যাওয়ার মতো।

ছয়.

ফাহিম ইতালি থেকে ঢাকায় ফিরে ফিরেই আবিরকে ফোন দিলো। 
সামনের শুক্রবার আমার বিয়ে। তোকে কষ্ট করে ঢাকায় আসতে হবে না। পাত্রী কিন্তু চট্টগ্রামের।
দেশে ফেরার আগেই পাত্রী রেডি। বাহ্। প্রবাসী বর বলে কথা। হেসে বলল আবির। 
চট্টগ্রামে থাকতে তোর কষ্ট হচ্ছে সে কথা ভেবেই সেখানে বিয়ে করছি। তুই বলছিস উল্টো কথা। 
আহারে আমার প্রতি তোর কতো দরদ। দেখা গেলো আমার প্রেমিকাকেই বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছিস। 
আমি মেয়ে হলে চোখ বন্ধ করে তোকে বিয়ে করতাম। তোকে বাদ দিয়ে যে আমাকে বিয়ে করতে আসবে তার মতো গাধা আর কেউ নেই।
আবার বেশি কথা বলছিস।
ভাই সত্য বলাও বিপদ। তুই একটা জটিল মানুষ। প্রসংশা করলেও রাগ করিস। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোর ঠিকানা ম্যাসেজ করে রাখিস। আমরা যাওয়ার সময় তোকে সাথে নিয়ে যাবো। 

সাত.
আজ ফাহিমের বিয়ে। সকালে ঢাকা থেকে ফাহিম সবাইকে নিয়ে রওনা দিয়েছে। চট্টগ্রামে পৌছার আগেই সে বিষয়টি আবিরকে ফোন দিয়ে জানায়। আবির রেডি হয়ে মূল রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকে। বেশ কয়েকটা প্রাইভেট কার এসে আবিরের সামনে দাঁড়ায়। সামনের প্রাইভেটকার থেকে ফাহিম বরবেশ নেমে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরে। চার পাঁচ বছর পর দু‘বন্ধুর দেখা। তারপর তারা গাড়ি উঠে বসে। নানা গল্প করতে করতে গাড়ি চলে যায় একটা কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানেই প্রবেশ করতেই আবিরের চোখে পড়লো সুসজ্জিত একটি মঞ্চ। লাল বেনারসি শাড়ি পরে বসে আছে কনে। নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফাহিমকে কনে পক্ষের লোকজন আমন্ত্রণ নিয়ে যায় কনের মঞ্চের দিকে। সাথে আছে আবিরও। সেখানে যাওয়ার পরই কনের দিকে চোখ পড়লো আবিরের। মুহুর্তেই তার শরীর ঘাম দিয়ে ফেললো। আবির কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। 
ফাহিম কনের পাশে বসার পর বলল, কিরে আবির তুই হঠাৎ করে দেবদাস হয়ে গেছিস কেন? ভাবখানা এমন যে তোর প্রেমিতকাকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছি। ব্যাটা এটা আমার প্রেমিকা। বছরখানেক প্রেম করে বিয়ে করতে আসলাম। এই অধরা আমার দেবদাস বন্ধুটাকে বলোতো আমার পাশে বসতে। 

অধরা কিছু বলার জন্য চোখ তুলে তাকালো আবিরের দিকে। দীর্ঘদিন পর আবার তাদের পরিচিত চোখের সাথে চোখের মিলন হলো। কিন্তু অধরা সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো। কিছু বলতে পারলো না। প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ছলনাময়ী, স্বার্থপর আর বিশ্বাসঘাতকের চোখ কখনও নিষ্পাপ চোখের দিকে চোখ রাখতে পারে না। 

লেখক:  সাদিকুল নিয়োগী পন্নী, প্রযোজক (অনুষ্ঠান), বাংলাদেশ টেলিভিশন

 


 

 

 

সর্বশেষ খবর