শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আহসান হাবীব কবিতার দর্পণে সমাজ অবলোকন

তুহিন ওয়াদুদ

আহসান হাবীব কবিতার দর্পণে সমাজ অবলোকন

আহসান হাবীব দীর্ঘ সাহিত্যিকজীবনে ৮টি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। গ্রন্থভুক্ত কবিতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। ৮টি কাব্যগ্রন্থে মাত্র ২৩৬টি কবিতা আছে। তার কবিতার বয়নকৌশলে আছে স্বকীয়তা। তার কবিবোধ ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। সময়ের যন্ত্রণা উৎসারিত পথে তার কবিতা চর্চার সূত্রপাত। ব্রিটিশ-ভারত পর্বে ১৯১৭ সালে তার জন্ম। নিজস্ব চিন্তার বলয় যখন নির্মিত হচ্ছে তখন তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের নিয়তিতে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন তখন তুঙ্গে।

ব্রিটিশ বিদায়ের সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল অনেক। শিল্পী-সাহিত্যিকরাও ব্রিটিশ খেদাও প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে অনেক লেখক তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ছিলেন উচ্চকিত। আহসান হাবীবের কবিতার অন্তর্কাঠামোজুড়ে সেই বোধের স্ফূরণ সহজে বোঝা যায়। বাংলা সাহিত্যের উনিশ শ চল্লিশের দশকে যারা কবিতার আকাশে ডানা মেলতে শুরু করেছিলেন তাদের অন্যতম আহসান হাবীব। কবিতার কাঠামো নির্মাণে তার পারঙ্গমতা পাঠককে ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট। যারা কবিতার প্রতি আকর্ষণ অনুভবন করেন তাদের কাছে আহসান হাবীবের কবিতা উচ্চাসনে আসীন।

আহসান হাবীব কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বিষয়কে শব্দের ব্যঞ্জনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন। কোন বিষয়টি নিয়ে তিনি লিখছেন সেটি যেন পাঠক কষ্ট করে আবিষ্কার করতে পারেন এমন একটি চেষ্টা তার কবিতার মধ্যে আছে। আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রি শেষ’ তার এক পরমতম সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এ কাব্যগন্থের কবিতাগুলোকে কয়েকটি পর্বে বিভাজন করেছেন। প্রহর, প্রান্তিক, প্রতিভাস, পদক্ষেপ- এ চারটি পর্ব আছে। কবিতাগুলোর পরতে পরতে কবির ব্যক্তিক অনুভূতিজুড়ে আছে দেশবোধ, আছে ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রতি ক্ষোভ। উপনিবেশের প্রতি চরম ক্ষোভ কবিতাগুলোর ভিতর তেজোদীপ্ত হয়ে আছে। দেশের প্রতি মমত্ববোধের উদ্ভাসও লক্ষণীয়।

ব্রিটিশদের প্রতি তার যে আক্ষেপ তা তিনি কবিতায় প্রত্যক্ষ ভঙ্গিতে আনয়ন করেননি। কবিতার পঙ্ক্তিতে-চরণে-শব্দে-ভাবে কবি যে আক্ষেপ রোপণ করেছেন তা পাঠককে আবিষ্কার করতে হয়। তারপরও ‘সেতু-শতক’ কবিতায় এসে তিনি আর নিজেকে আড়াল করতে পারেননি। এখানে সংখ্যার আড়ালে ব্রিটিশ চরিত্র ধরা পড়েছে। ইতিহাসের পাঠ উঠে এসেছে এ কবিতায়। দুইশ বছরের উপনিবেশ হয়ে উঠেছে কবিতার উপজীব্য। এখানে ব্রিটিশদের তিনি দস্যু বলে অভিহিত করেছেন। দুইশ বছর যেন ভারতের মানুষের ঘুম হরণ করেছে তারা। কবির ভাষায়- ‘দুই শতাব্দীর সেতু পার হ’য়ে এসেছি এখানে,/ আমার অশান্ত আত্মা কেঁদে ফেরে এখনো যেখানে/ ঘুম নেই নয়নে আমার,/ এখনো নয়নে কাঁপে মীরণের তীক্ষè তলোয়ার!’

‘রাত্রি শেষ’ এর কবিতায় আছে অন্ধকারের ক্লেদ। সেই ক্লেদাক্ত সময়ের একচ্ছত্র আধিপত্য কবিতায় উচ্চারিত হয়নি। আশাবাদের আলোও এসেছে অবারিত। এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘দিনগুলি মোর’ শুরুই করেছেন- ‘দিনগুলি মোর বিকলপক্ষ পাখির মতো/ বন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণায়মান।’ সমাজের গভীরে জেঁকে বসেছিল ব্রিটিশ শোষণ। সময়ের গভীরে গ্রথিত হয়েছিল তার বীজ। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্প ছিল ছড়ানো। প্রথম কবিতায় তিনি লিখেছেন পাখির বিকল পাখার কথা। তারপরেই লিখেছেন- ‘ঝরাপালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়,/ তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়।’

শক্তিশালী এবং ঝরঝরে পদ্যের বাঁধনে কবি আহসান হাবীব ‘রাত্রি শেষ’ কাব্যগ্রন্থ শেষ করেছেন। কবি হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনার আধার এ কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই ভারতবাসী জেনে গেছে ব্রিটিশ উপনিবেশের যবনিকাপাত হচ্ছে। এ কাব্যগ্রন্থের ‘শরৎ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘বা’র্তা লয়ে চারিদিকে ঘুরিতেছে নিষ্প্রভ-সেনা।’ ‘সৈনিক’ কবিতায় লিখেছেন- ‘তবুও সৈনিক মোরা, নিরস্ত্র নির্বেদ তাই/ আমাদের অপূর্ব লড়াই।’ আহসান হাবীব কবিতার মাধ্যমে যেন মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা হেতু তার কবিতায় প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে। একেকটি কবিতা যেন একেকটি সংগ্রামের প্রস্তুতিকথন। ‘স্বাক্ষর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘সংগ্রামের রাজপথে হাতে হাত রেখে/ সমান পায়ের চিহ্ন যাব এঁকে এঁকে/, ডেকে যাব মানুষেরে, মানুষের অবচেতন মন,/ দিয়ে যাব জনে জনে মরণের যুঝিবার পণ!’

আহসান হাবীবের লেখায় রাত্রি শেষ হয়েছে এমন কবিতা হচ্ছে ‘রেড্ রোডে রাত্রি শেষ’। কবিতাটি সম্পূর্ণ নাম কবিতা না হলেও নাম কবিতার মতোই। এ কবিতায় কাব্যগ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা ফুটে উঠেছে। ব্রিটিশরা চলে যাবে এটি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামকরণে লেখক একটি বার্তা দিয়ে গেছেন। কাব্যগ্রন্থের অপরাপর কবিতাগুলোতে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেই তুলনায় রাত্রি শেষ হওয়ার সুর বেজে উঠেছে এই কবিতায়। সংখ্যায় কম হলেও রাত্রি শেষ হওয়ার প্রসঙ্গটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। রাত্রির অন্ধকার দূর হওয়ার গল্প মূলত ব্রিটিশ বিদায়ের গল্প। রাত্রি শেষে যেন স্বাধীনতার আলো জ্বলে উঠছে।

‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থে আহসান হাবীবকে আমরা নতুন রূপে পাই। ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ বিদায় হয়েছে। ফলে উপনিবেশে যাপিত জীবনের পরিবর্তে পাকিস্তান পর্বে জীবনের ধরন বদলেছে। পাকিস্তান সরকার নতুন শোষক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তখন তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে বিরোধ নিজ দেশে, নিজ সরকারের সঙ্গে। ১৯৬২ সালে যখন ‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখনো শোষণচিত্র পরিষ্কার। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৬ দফা উপস্থাপনের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বাধিকার-স্বাধীনতার যে অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠ বেজে উঠেছিল তা তখনো বেজে ওঠেনি। তাই ব্রিটিশ বিদায়ের পরবর্তী অনুভূতির এক নিবিড় বিকাশ ঘটেছে এ কাব্যগ্রন্থে। আহসান হাবীব ‘রাত্রি শেষ’ কাব্যগ্রন্থে দেশপ্রেমের কথাটি শব্দের ব্যঞ্জনায় রূপকে-প্রতীকে-ইঙ্গিতে বারবার বলে গেছেন। ‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় সেই বোধের কথামালাকে তিনি কোনো কিছুর আড়াল না করে নির্দিষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন- ‘তোমাতে অমর আমি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘মায়ের বুকের মতো বুক পেতে রাখা এই/ দেশেকে আমি ভালোবাসি সে কথা সে সোনার দেশের/ আকাশে অরণ্যে আর সমুদ্রে ঢেউয়ে লেখা আছে।/ লিখেছি আপন মনে একা আমি আমার দিনের/ সারা পথে; মাকে আর প্রেয়সীকে আর এই দেশকে/ আমি ভালোবাসি এই ছোট কথাটি প্রত্যহ/নানা রঙে/ এঁকেছি তোমার বিচিত্র রঙের তুলি হাতে নিয়ে।’ এই কাব্যগ্রন্থে এসে কবিকে আমরা ঐতিহ্যঘনিষ্ঠ অনুভূতির লেখক হিসেবেও পাই। ব্রিটিশ বিদায়ের পর দেশটাকে নতুন করে সাজানোর কথাও তিনি বলেছেন। দুইশ বছরের শোষণে ক্ষতবিক্ষত দেশ নতুন করে সাজানো হবে। কবির মনে সেই আশাবাদ জেগেছিল। ‘ভাঙাচোরা দেয়ালের স্তূপাকার’ ইট সরিয়ে নতুন আবেগে নতুন ইট তৈরির কথা বলেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন শোষণের দিন শেষে মুক্তির আলোয় তখন স্বাধীন দেশ। তবে কিছু সংশয় যে ছিল সে কথাও তিনি লিখে রেখে গেছেন। ‘জীবন’ কবিতায় কবি বলেছেন- ‘পথে পথে সংশয়ের সন্দেহের ধূলি ওড়ে কত,/ বেদনায় নত/ দুই চোখ ঝরে অশ্রু নিয়ে/ দু’হাতে মনের মতো নানামত পাথর বানিয়ে/ গড়ি তাজ; করি কাজ প্রেমে ও সংগ্রামে।’

‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় তার গভীর মৃত্যুচিন্তা ফুটে উঠেছে। কবি মাত্রই বিচিত্র চিন্তার আশ্রয়ে গড়ে তোলেন কাব্যসম্ভার। মৃত্যুর মতো অনিবার্য বাস্তবতাকে নিয়ে তাই শিল্পী-সাহিত্যিকদের শিল্পকীর্তির কোনো অভাব নেই। আহসান হাবীবকে ‘তামসিক একটি মুহূর্ত’ কবিতায় মুত্যুভাবনায় ডুবে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করা যায়। বিপুল কর্মযজ্ঞময় এ পৃথিবী। কবি নিজেও কর্মযজ্ঞে ডুবে থাকা মানুষ। তিনি যেন মৃত্যুর কথা ভুলেছিলেন। প্রাণপ্রাচুর্যের আধার এই পৃথিবীর বুকে তিনি যেন হঠাৎই মৃত্যুর কথা ভেবেছেন। তার ভাষায়- ‘একদা হঠাৎ এক অপরাহ্নে মনে হলো/ মৃত্যু কঠিন হতে পারে।’ এই কবিতায় তিনি আরও লিখেছেন- ‘মনে হলো এ পৃথিবী আরো/ অনেকদিন বেঁচে রবে/ মৃত্যু হবে আমার এবং/ যদিও অক্লান্ত স্বরে অপরাহ্নে ঘুঘুদের ডাক/ শোনা যাবে/ আমি তা শুনবোনা।’ 

আহসান হাবীবের ‘রাত্রি শেষ’ কাব্যটি প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ উপনিবেশ পর্বে। ‘ছায়া হরিণ’ এবং ‘সারা দুপুর’ কাব্যগ্রন্থটিও প্রকাশিত হয় পাকিস্তান পর্বে। বাকি পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ পর্বে। ‘সারা দুপুর’ কাব্যগ্রন্থটিও সময়ের প্রতিচ্ছবি। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের আকাশে স্বস্তির কোনো অবকাশ দিতে পারেনি দেশবিভাগ। রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সর্বত্রই ছিল পাকিস্তানি ভয়াবহ ব্যাধি। কোনো কিছুরই সুষ্ঠু বিকাশের পথ খোলা ছিল না। আহসান হাবীবের কবিতায় সেসব কিছুর বিস্তর আলোড়ন স্লোগানমুখর ভাষায় বিস্তৃতি লাভ না করলেও সেসব উপেক্ষিত হয়নি। সারা দুপুর কাব্যগ্রন্থের ‘সূর্যসঙ্গ’ কবিতায় কবির অন্তর্গত এক বোধ ফুটে উঠেছে। দেশবিভাগের ভিতর দিয়ে আমরা একটি ভোরে এসে পৌঁছেছি। সেই দিন সম্পর্কে আহসান হাবীব ‘ছায়া হরিণ’ কাব্যগ্রন্থে নতুন করে দেশ সাজানোর কথা লিখেছেন। কিন্তু ‘সূর্যসঙ্গ’ কবিতায় এসে আরেক ভোরের অপেক্ষায় কবি প্রহর গুনছেন। বোঝা যায় যে দিন এসেছে সেই দিন সুখকর হয়ে ওঠেনি। কবির ভাষায়- তুমি দেখো তোমার নিজের/ গৃহকোণে কদম-কেশরে/ ভোরের পাখির গান সারাদিন মূক হয়ে আছে/ পথ চেয়ে আছে দেখো আরেকটি ভোরের।’ এ কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা ‘প্রাজ্ঞ বণিকের প্রার্থনা’। এ কবিতায় কোথাও স্পষ্ট করে কিংবা সরল রূপময়তায় বিষয়কে তুলে আনেননি। তবে কবির অপরাপর কবিতার নিরিখে এবং কবিবোধের চারিত্র্যে বুঝতে অসুবিধা হয় না কবি কোন বিষয়ের আলোকে ‘পীড়নমুক্ত প্রাজ্ঞ মুহূর্তের সূর্যোদয়’ সন্ধান করেছেন। কৈশোর-যৌবন কাটিয়েও কবির তৃষ্ণা মেটেনি। যে স্বাধীনতা আমরা দেশবিভাগে পেয়েছিলাম তাকে যেন কবি এমন সোনা বলেছেন যে সোনায় ভরপুর দেশ। কিন্তু যে জীবন আমরা চেয়েছিলাম সে জীবন যেন ভীষণভাবে অনুপস্থিত। শুধু স্বাধীনতা কখনো সুখ দিতে পারে না। এর জন্য চাই জীবনবোধ। জীবনের অনুগামী রাষ্ট্রচরিত্র। কবির ভাষায়- ‘সোনার কুৎসিত কাঠিন্যে প্রাণ ওষ্ঠাগত-/ আকণ্ঠ পিপাসা আজ এক বিন্দু নির্মল জলের/ সে-নদীর যে-নদীর অশান্ত কল্লোল/ অতিক্রম করে গেছে দীর্ঘ বহু বৎসরের পথ,/ আার এ কারাকক্ষ দূরে রেখে দিনে দিনে সমুদ্রে উধাও।’

আহসান হাবীবের ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ ‘আশায় বসতি’। এ কাব্যগ্রন্থে জগৎকে একরৈখিকভাবে দেখেননি। কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যেই উপ্ত আছে কবির আশাবাদী চেতনা। তৃতীয় কাব্য প্রকাশের পর বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গেছে। যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু নতুন ভূখ- নতুন স্বপ্ন বাঙালি জীবনের চরম-পরম প্রভাব বিস্তারকারী অনুষঙ্গ। সত্তরের দশেকের কবিরা মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে কবিতার নানামাত্রিক রূপ দেওয়ার সাধনায় রত ছিলেন। কখনো কখনো আবেগের আতিশয্যে শিল্পমান ক্ষুণœ হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত আবেগে মুক্তিযুদ্ধকে তারা কবিতায় বেঁধেছেন অবারিত ভালোবাসায়। আহসান হাবীব সবসময়ই বিষয়কে কয়েক স্তরের মোড়কে রেখেছেন দূরে। স্বাধীনতা-পরবর্তী কালের কবিতা রচনাতেও সেই প্রবণতা থেকে সরে আসেননি। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সরাসরি কোনো বিষয়ের অবতারণা তার কাব্যে তুমুলভাবে আসেনি। এ কাব্যগ্রন্থে কবি বিচিত্র বিষয়ে নিজেকে যুক্ত করেছেন। কখনো নিজেকে ‘কথার মনোরম কাঙাল’ বলে উল্লেখ করেছেন। নদী নিয়েও লিখেছেন কবিতা। তবে সময়ের যন্ত্রণা একেবারেই ভুলে যাননি। সময়ের প্রতিকূলতার মধ্যেও আত্মবিশ্বাসও আছে। ‘বৈরী বাতাস, অতপর... ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘থাকে বৈরী বাতাসের মুখোমুখি। উথালপাথাল/ নদীর নিঃসীম বুক। সরাসরি ঘাটের নৌকোয়/ জ্বলে না মশাল; জ্বলে সারা বুকে ব্যাপ্ত পারাপারের বাসনা।’ বাস নেই কবিতায় আশাহত মানুষকে সুখী মানুষের অভিনয় করতে দেখা যায়। ‘আপন-স্বভাবে’ কবিতায় নিজের স্বভাবের পরিণতি নিয়ে লিখেছেন। ‘একটা লোক’ কবিতায় এমন একজন লোকের সন্ধান করেছেন কবি যিনি প্রকৃত অর্থেই হবেন মানুষ গড়ার কারিগর। ঘুরেফিরে বিবিধ বিষয়ের অবতারণা শেষে কবি যেন আবার ফিরে আসেন দীর্ঘ কবিজীবনের মূল সুরে। যে রাজনীতি-সমাজের জয়গান গেয়েছেন সেখানেই তিনি আবার ফিরে আসেন। ‘মিছিলে অনেক মুখ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন- ‘সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দীপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল-উত্তাল।’ সময়ের ব্যাধি, ক্ষুধা এসব বিষয়ও উঠে এসেছে ‘আশায় বসতি’ কাব্যগ্রন্থে।

‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’ আহসান হাবীবের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। এখানেও তিনি বিবিধ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। কবিতার অঙ্গসৌষ্ঠব গঠনে স্বকীয়তা বজায় রেখেইে সে কাজটি তিনি নিপুণভাবে সম্পন্ন করেছেন। সমাজে বিবমিষা, ক্লেদ এমনকি অশান্তির অসুখ ছিল। কিন্তু কবি সেসব মেনে নিয়ে পথ চলছিলেন। ‘সময়-অসময়’ কবিতায় তিনি বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার কথাই উচ্চারণ করেছেন। ‘যখন যেমন ইচ্ছা সময়ের সঙ্গে থেকে যাই’- এমনটাই কবির প্রত্যয়। কবি এ কবিতায় লিখেছেন- ‘সময় ফু’রিয়ে গেছে বলে যখন চিৎকার করো, দুঃসাহসে আমি যাই চ’লে/ সময়ের জন্মকালে, বিনষ্টির কাছাকাছি যাই/ নষ্ট হয়ে যাওয়ার শঙ্কার সেই তীব্রতাকে ধ’রে রাখতে চাই।’

‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ কাব্যগ্রন্থটি তার শেষ কাব্যগ্রন্থ। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। এ কাব্যগন্থের একটি কবিতায় তিনি নিজেই নিজের কবিতার বিষয়গত ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। তার ভাষায়- ‘কবিতাকে রাজনৈতিক বক্তৃতা করে তোলার পক্ষপাতী নই বলি।/ বরং কবিতা হোক রাজনৈতিক মঞ্চের বিশুদ্ধ/  প্রেরণা, আমি পেয়েছি।’

আহসান হাবীবের কবিতা মান বিচারে শিল্পসফল। তিনি নিজস্বতাকে বজায় রেখে একটি কবিতার জগৎ গড়ে তুলেছেন। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সেই স্বাতন্ত্র্য আর উচ্চতা কালের প্রবাহে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন হেতু তিনি শিল্পমান অক্ষুণœ রাখতে কোনো কার্পণ্য করেননি। বরং তার কবিতার সংখ্যা সীমিত হওয়ার নেপথ্যে এ এক কারণ হতে পারে। আহসান হাবীব গদ্য-পদ্য উভয় ধারাতে লিখলেও পদ্যেই তার খ্যাতি অধিক। বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ আহসান হাবীব।  

সর্বশেষ খবর