শুক্রবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সীমান্ত

সিফাত উদ্দিন

সীমান্ত

শীতের মধ্যরাত। এমনি এক রাতে পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তিক গৃহে উচাটন মনে বিছানাতে শুয়ে কেবল এপাশ-ওপাশ ফিরছে এক তরুণ। কম্বলের ভাগাভাগিতে ঠান্ডা আর উষ্ণতার লুকোচুরি খেলা চলছে। মুখ ঢাকলে পায়ের পাতা জমে যায়। পা ঢাকতে গেলে ঠান্ডায় মুখে দাঁতের পাটি কিড়মিড় করে। শ্যাম রাখি না কূল রাখি! মুখ আর পায়ের যখন টানাহ্যাঁচড়া চলছে তখন সিঁদেল চোরের মতো হিমেল তাপ কম্বলের ফাঁকা আর ফুটো হয়ে যাওয়া পথে প্রবেশ করছে। সে এক নিদারুণ পরিস্থিতি! তবে এটা বেশিক্ষণ চালানোও যাবে না। হাতে আর সময় বেশি নেই। শার্টের ওপর চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। ঘরের কাউকে না জানিয়ে, নির্বিঘ্ন স্বপ্নে অথবা ঘুমে ডুবিয়ে রেখে নিঃশব্দে প্রস্থান করতে হবে।

দেহ আর মনের এমনি এক পরিস্থিতির মাঝে দ্বারের বাইরে পা বাড়াল হাসান। স্কুলের পেছনে রাজন অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে নিয়ে শেকু মামা রওনা হবেন। তরুণ হাসানের মনের মধ্যে রোমাঞ্চ-ভয়-আনন্দ আর দ্বিধা জট পাকিয়েছে। ভয়টা বেশি কাজ করছে। নাকি রোমাঞ্চ সে নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে! গতকালই শেকু মামা বলেছিলেন যে, রথ দেখা আর কলা বেচা এক সঙ্গেই হবে। শেকু মামা হাসানের বন্ধু রাজনের মামা, গরু ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী মানে সীমানার ওপার থেকে গরু নিয়ে আসেন। গরুপ্রতি পাঁচশ থেকে ১ হাজার টাকা। ঝুঁকির মাত্রার সঙ্গে টাকার পরিমাণের সমানুপাতিক সম্পর্ক এখানেও। সপ্তাহে দুই-একদিন গরু নিয়ে এসে মামা বাকি দিন খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন। মামা খুব একটা পড়াশোনা করেছে বলে রাজনের জানা নেই। শেকু মামাই রাজনের হিরো। রাজন তার মামার গল্প করতে করতে বলত স্কুলের পড়া শেষ করে সেও মামার মতো হবে। মামার গল্পে গল্পে কতদিন যে স্কুল থেকে বাড়ি চলে এসেছে ইয়ত্তা নেই। এলাকার সব গরু ব্যবসায়ীর কীর্তিগাথা শুনতে শুনতে রাজনও সফল গরু ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে।

বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে হাসান এখন রাস্তায়। তেলবিহীন ধূসর চুলের মতো আঁধার নেমেছে চারদিকে। রাতের আঁধারে কুয়াশা নেমেছে দলছুট মেঘের মতো। কোথাও হাঁটতে হাঁটতে পেজা তুলোর মতো কুয়াশা আলতো স্পর্শে জড়িয়ে ধরে গা। আবার খানিক পরে মিলিয়ে যায়। এমনই মায়াময় রাতে কৈশরিক স্থিরহীন চিত্তের অনির্বচনীয় অনুভূতি নিয়ে হাসান এগিয়ে যাচ্ছে। শীতের হিম তার রোমাঞ্চের উত্তাপের কাছে হার মেনেছে। বিন্দু বিন্দু ঘামছে হাসান। হাসানের গৃহকোণের দারিদ্র্য আর বয়সের কৌহূহলকে সীমান্তপারের হাতছানি উসকে দিয়েছে। কেবল নতুনের আবাহন ধ্বনিত হচ্ছে তার কানে। আজ চলতে চলতে যে রাস্তার ধারের কবরস্থানকে ও ভয় পাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর; মৃত্যুর চেয়েও রোমাঞ্চকর অথবা তার চেয়েও সুন্দর কোনো মুহূর্তকে সে উন্মোচন করতে চলেছে।

ভাবতে ভাবতে বাজার চলে এসেছে সামনে। বাজার পেরুলেই স্কুল। হঠাৎ করে শরীরটা ভয়ে জমে গেল হাসানের। একি ভুতুড়ে জায়গা দিয়ে হাঁটছে ও! এই কি বাজার? নাকি শত বছরের পুরনো পরিত্যক্ত শহর? একটি আলো ফুটে উঠলেই যে জায়গাটা ফেরিওয়ালা-দোকানি আর ক্রেতাদের হাঁকডাক আর দরদামের চেঁচামেচিতে সরগরম থাকে, এখন সেই একই জায়গায় কেমন কবরের সুনসান নীরবতা। হাসান দ্রুতলয়ে জায়গাটা ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় স্কুলের মাঠে ঢুকে পড়ে। কিন্তু মাঠের মাঝ দিয়ে পেরুতে গিয়ে হাসানের নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ বোধ হলো। মনে হলো যেন অন্ধকার রাত্রিরে সুবিশাল আকাশের নিচে বৃহৎ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে সে একা। পৃথিবীর শ্বাপদসংকুলতার সঙ্গে লড়াই করে এগিয়ে চলেছে। খুব একা! নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতা সর্বস্ব দার্শনিক অনির্বচনীয় বোধ জাগছে ওর মনে। সহসা অন্য এক হাসানের সত্তাকে অনুভব করছে ও। গত ষোল-সতের বছর যে মানুষগুলোর সঙ্গে বাস, আজ এক রাতেই তাদের অন্ধকারে রেখে কেমন স্বার্থপরের মতো বেরিয়ে চলে এল! স্কুলের পেছনে পৌঁছে রাজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ মুহূর্তে ঠিক এ বোধটা হাসানকে পোড়াচ্ছিল। শীতের অন্ধকারে রাজনের আবছা অবয়ব দেখে হাসানের অব্যবহিত আগের সব আতঙ্ক-অস্থিরতা প্রশমিত হতে শুরু করল। এতক্ষণ হাসান ভীতসন্ত্রস্ত ছিল, তা কিন্তু নয়। তবুও রাজনকে দেখামাত্র অনেকটা নির্ভার অনুভব করল সে।

কীরে তুই ভয় পাইছিল মনে কয়। বলে হাসতে লাগল রাজন। রাজনের গায়ে কোনো চাদর নেই। কেবল একটা শার্টের উপরে সে আরেকটা পরে চলে এসেছে। কেমন নির্ভার। হাসান আশ্বস্ত হলো রাজনের কথায়।

আরে নাহ ভয় না। বারির কাউরে না কইয়ে আইসি। তাই মনডা কেরাম কেরাম কইত্তিছে। হাসান বলল।

ধুর বাড়া! ভয় পালি অয়? মামা আছে না। সে কি সরল আত্মবিশ্বাসের হাসি রাজনের কণ্ঠে। আমার এরাম সমস্যা নেই। আমি কইয়ে আইসি যে মামার সঙ্গে বর্ডারের ঐ পারে যাব। গরু আনব। বলতে থাকে রাজন। রাজনের আপাত মর্জি হলো হাসানকে নিয়ে দ্রুত যাত্রা শুরু করা। শেকু মামা বলেছেন তিনি স্কুলের পেছনে আসবেন না। তাতে পথ বেশি ঘোরা হয়ে যাবে। বরঞ্চ রাজনরাই মামার নির্ধারিত স্থানে চলে যাবে। সোনাই নদীর ধারে অপেক্ষা করবে। লোকালয় যেখানে শেষ, সেখানেই নদীর পাড়ের শুরু। পাড় ভাঙতে ভাঙতে মানুষের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সোনাই নদী। নদী পার হলেই ভিন দেশ। এই সোনাই নদীই এখন দুই দেশের সীমারেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে নদী আজীবন কেবল যুক্ত করে গেছে নিকটদূর, মানুষে মানুষে, আজ সেই নদীই বিভেদের সীমারেখা! কিন্তু সবইতো মানুষের কল্পনা। তবে মানুষের কল্পনাপ্রসূত নতুন নামকরণভাবনা নদীর শাশ্বত ধারা পাল্টাতে পারে না। নদী বহমান থাকে। প্রাণবন্ত নদী পৃথিবীর বুকে, আর মৃত নদী বয়ে চলে মানুষের স্মৃতিতে-কল্পনায়।

ভোর হতে ঢের বাকি। রাতের হিমেল আঁধার কেটে দ্রুতলয়ে পা ফেলছে হাসান আর রাজন। নিঃসীম আকাশে একাকী চাঁদের নিঃসঙ্গতা অজস্র তারার অস্ফুট উপস্থিতিতে ঘুচে গেছে।

রাজন যেতে যেতে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। হাসান থেকে থেকে হু-হাঁ বলে দায়সারা সাড়া দিচ্ছে। সংশয় কাটছে না হাসানের। নিজের ভিতরে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। কী ঘটতে পারে না পারে। কী হলে কী করবে? ইত্যকার নানা প্রশ্ন। তবে নিজেকে কিছু প্রশ্নের জবাব গোঁজামিলভাবে দেওয়া গেলেও কিছু প্রশ্ন উত্তরহীন রয়েই গেল।

সোনাই নদীর ধার থেকে তখনো একটু দূরে থাকতেই বসে থাকা চারটি কালো মূর্তি দেখতে পেল। মূর্তিবৎ বসে থাকা এ মানুষগুলোর একজনের ঠোঁটে সিগারেটের আগুন। আরেকটু কাছে যেতেই দেখা গেল ধূমপায়ী লোকটা আর কেউ নয়, রাজনের মামা। ধূমপায়ী লোকটার তৈলাক্ত চুলের সিঁথির ভাঁজ চাদের পেলব আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে। মামার পাশে গিয়ে বসল রাজন। তার পাশেরজন তখনো গামছা মাথায় পেঁচিয়ে দুই হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে ঝিমুচ্ছে। অপর দুইজন চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। তখনো মূর্তিবৎ বসে থাকা দুটি মানুষের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটেনি। এ দুইজন হাসান-রাজনদের মতো শেকু মামার মক্কেল নাতো? হাসান তাদের দিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করল।

রাজন মামাকে হাসানের কথা বলতেই মামা যেন তার গল্পের ঝুলি খুলে বসলেন।

আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তোর বয়সে আমিও ঐ পার গিছি। তন কাঁটা তারের বেড়া ছিল না। গুঁড়া দুধ থেকে শুরু করি গরম মসলা, ডাইল, গরুর পাল কি না আনিছি। এবছর গরু আনতে গেলে এটু সমস্যা হসসে। হুর! কোন ব্যাপার? গুলি ওরা করেই। কোনবার কইয়ে, কোনবার না কইয়েই করে। তায় এসময়টাই বালা। কি কইস তোরা? বলেই হাসলেন শেকু মামা।

রাজনের পাশেরজন হাসির কিংবা কথার শব্দে অথবা কাকতালীয়ভাবে ঘুম ভেঙে চোখ খুললেন। আমাদের দেখে বললেন, চলে আইসে ওরা?

হ্যাঁ! এই আমার বাইগনে। আর ওইডে ওর দোস্ত।

আমাদের দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

একবার এক লাইনে বেয়াল্লিশটা গরু নিয়ে আইলাম। তোর মনে আছে শেকুবাই। শ’এ শ’এ গুরা দুধের প্যাকেট নি আসতাম। দুধের গায়ে খালি লিখা রাখত শাবানা-ববিতা! নাম কইলেই বুঝতাম দুধ!

বলেই হাসি আর সঙ্গে কাশি।

মামার পাশের লোকটা নেশার ঘোরে কিংবা ঘুমের ঘোরে কোত্থেকে বলা শুরু করে দিল। কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল। এ পার কোশ, ও পার কোশ, ওরে! টাহা দিলি সবগুলি ঠান্ডা। তয় এহন এটু চাপাচাপি বেশি। দেহা মাত্তর গুলির নির্দেশ।

এ কথা শুনে হাসানের বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে। ও একবার রাজনের দিকে আরেকবার শেকু মামার দিকে তাকায়। কিন্তু অবাক কান্ড! কারও কোনো বিকার নেই! বিকার যে নেই তা ঢের টের পাওয়া যাচ্ছে। মামা বলছেন হাসানদের বয়েসে ওপার গিয়েছে আবার অন্যজন বলছে এত অল্প বয়েসে যাননি। কথার সত্যতা যাচাইয়ের বাসনা বা ফুরসত কোনোটাই হাসানের নেই।

আরে ট্যাকা দেখলে যে কেউ হাত বাড়ায়, শুনিছ নাই?

বলেই কটাক্ষের হাসি হেসে উঠলেন লোকটা। ট্যাকা বারায়া দিলি গুল্লিও বারোয়না।

শেকুবাই তোর মনে আছে? আমরা যখন পয়লাবার ওইপার গিলাম, তহন আমাগির বয়স কতইবা ছিল? উনিশ-কুড়ি। আর ইগিরতো বালই উঠেনি। তায় এরা আবার ওপার যাতি চাসসে।

শেকু মামা মাথা নাড়ে আর বিড়িতে টান দেয়। দুজন দুরকম বলছে। একজন বলল হাসানদের বয়েসে গিয়েছে, আরেকজন বলে উনিশ-কুড়ি বছর বয়েসের কথা। খাপছাড়া কথার আলাপ শুনে হাসান আরও ভড়কে গেল।

ওপার যাআর কি নিশা দেখ। কতজন কত কারণেই না যাই। কারণ না থাকলে বিনা কারণে যাই।

রইচ তোর মনে আছে? বাদনাতলার রামের বাই সংকর সে কি ফুটবল খেলত! স্বপ্ন দ্যাখতো ফুটবলার হবি। গরম-বাদলার কোনো মানামানি নেই। সেই দুপুর থিকি খেলা শুরু করছে মাগরিবের আজান পড়ছে। সেদিকে ওর খেয়ালও নেই। খেলি যাসসে তো যাসসে। ভালো কোনো দলে ঢোকতি পাল্ল না। এক সময় ওর মনে অলো ও আর ফুটবলার হতি পারবি না। সেই দুঃখে সেও সীমানার ওপারে চলি গ্যাল। ওই যাওয়াই শ্যাষ। আর আসল না।

হাসান বুঝল নেশা কিংবা ঘুমের ঘোরে যে বক্তা এর আগে কথা বলছিলেন তিনি রইচ।

আরেকবার জয়নাল খুড়ার সঙ্গে দেখা বাজারে। শেকু মামা এবার বলতে শুরু করলেন। আমারেই দেখিই কইল, ‘সপ্নলি গেল, আমার তো কেউ নিল না।’ ওরে জিজ্ঞিস কললাম, জয়নাল খুড়া তুমি যায়ে কি করবা। তুমি চিকিৎসাও করাবা না গরু ও আনবানা। তালি কি যাবা মত্তি? একবার স্টোক করে তার বাম হাত বাম পাসহ শরীরের বাম দিক প্রায় অচল হই গেছিল। আমারে কলেন।’ শেকুরে খালি বাইচা থাকা আর টাহা কামানোই কি জীবন। মাইনষের মনডা চায় বর্ডার পারায়ে যাইতে। কেউ যায় নতুন জীবনের লাগি, কেউ যায় পেটের দায়ে, আর কেউ মনে কর যায় আরেকটা নতুন মানুষ দেহার জন্যি। বর্ডার ডেংগাইতে তার কোন কারণ লাগে না রে।’ আমি খুড়ার কথা থিকি যা বুঝতি পালাম তা অল ঐ পার যাতি তার মন টানতিছিল। ওপারে তারও যাওয়ার বন্দোবস্ত কললাম। সঙ্গে একজন হেলপার দিলাম। ঘুইরা আসার কিছু দিন পর মারা গিলেন জয়নাল খুড়া।

এভাবে গল্প বলিয়েদের সীমান্ত গল্প চার শ্রোতা শুনতে লাগল মন দিয়ে। আর সোনাই নদীর পাড়ে প্রহর বাড়তে লাগল। নদীর জল শান্ত। এই শান্ত জলে বসে স্থির চাঁদও যেন এই মানবিক গল্পের শ্রোতা। এতক্ষণে কুয়াশার কুহকী খেলা বন্ধ হয়ে ঠান্ডার প্রকোপ বেড়েছে।

চল আগাই। সময় হইল। সবাইকে তাড়া দিলেন শেকু মামা।

হাসানও ওঠে দাঁড়াল অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে। এতক্ষণ গল্পে গল্পে আর শীতের হিম টের পাচ্ছিল না। ওঠে দাঁড়াতেই মনে হলো পৌষ তার সব হিম ঢেলে দিল গায়ে। দাঁড়াতেই চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল ঠান্ডা। উপায়ান্তর না দেখে দুই হাত বগলে চেপে হাঁটতে শুরু করল হাসান।

বাইগনে বুঝলি! ঐ পারের মানুষ এ পারের মাইনষেরে চেনার লাইগা কতা কতি অয়না বুজলি। দূর থেকে দেখলেই চিনতি পারে। ক্যামনে জানোস?

ক্যামনে? রাজন জিজ্ঞেস করে। চুলের কাটিং ফিটিং, হাঁটনের ছিরি। এগুলান দেখলেই কতি পারে। বলেই আরেক পশলা হেসে নিলেন রইছ মামা। আর উপায় নাই। ঐ পারে গেলেই ধরা। হাসানের স্বগোতুক্তি। ততক্ষণে সবাই শেকু মামাকে সামনে রখে নদীর পাড় ঘেঁষে উত্তর দিকে রওনা দিল। উত্তরের দিকে খানিক এগিয়ে যেতেই দেখা গেল এই অংশের নদীর পানি অনেকটা শুকিয়ে গেছে। ওপারে আখখেতের লম্বা সারি। আর এ পারে স্বল্প ঘন জঙ্গল। জঙ্গল দিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে রইল সবাই। হাসান অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায়না তবু ও এদিক ও দিক তাকায়। ভয় হয়, এই বুঝি সব আতঙ্ক বাস্তব রূপ নিল। খানিক পর এক আগন্তুক হঠাৎ উদিত হলো। এক নতুন খবর নিয়ে।

শেকু ভাই, লাইন ক্লিয়ার ওইতে মনে লয় ম্যালা দেরি ওইব।

শেকু মামার ঠোঁটে তখন সিগারেটের শেষ অংশটুকু জ্বলছিল। শেষ টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিলেন।

ক্যান!

খুব স্বাভাবিক অভিব্যক্তি নিয়ে শেকু মামা জিজ্ঞেস করলেন।

অহনও হেই পার থেকে কোনো সেগনাল আয় নাই। বলেই লুঙ্গিতে একটু ভাঁজ মেরে নিচে বসে পড়ল আগুন্তুক। অহনও উচ্চের বাত্তিইতো জ্বালায় নাই। হারামি গুলান ঘুমাইতাসে মনে অয়!

ঘুমাক! তোর এত টেনশন ক্যান। আইজ না-ইলে কাইল জামু!

‘না না! আজ রাতেই! এত্ত শীতে আর টেকা যাচ্ছে না।’ ভাবতে ভাবতে ঠান্ডা কাঁপুনি লাগল শরীরে যেন হাসানের। দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। চেকপোস্ট দিয়ে সীমানা পার হওয়ার সময় পাসপোর্ট-ভিসা-টিকেট-বিদেশি টাকা আরও কত কি লাগে শুনেছে হাসান। এভাবে এদিক দিয়ে যেতে তার চেয়ে কম ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না! ঝুঁকির ঝক্কি! হয়তো সেটা কেবল হাসানেরই লাগছে! বাকিদের এ নিয়ে অবশ্য মুখে কোনো রা নেই। তাদের কাছে কেবল এই মরা নদীটাই! পার হতে পারলেই নতুন দেশ! বর্ষাকাল হলে ডিঙি নৌকায় আর শুকনাকালে পায়ে হেঁটে। পার তারা হবেই! নৌকায় গেলে এক সঙ্গে দশ বারোজন নদী পাড়ি দিত। এখন নদীতে পানি কম। নদীর বালুচর পেরিয়ে কোমর জলে নামতে হবে। তাও ছ’ কদমের বেশি না। তারপর ওপারে আবার বালুচর। বালুচর থেকে ওপরে উঠতে গেলে পড়বে আখের খেত। এটুকুন জায়গাই পেরুনো নিয়ে কত ফন্দি-ফিকির। জানা গেল ওপারেও এরকম একদল অপেক্ষায় আছে এপারে আসার জন্য। ওপার থেকে সিগন্যাল মিললে তবেই এপার থেকে লোক রওনা দেবে। সিগন্যাল থেকে সিগন্যালে এপার থেকে ওপার। ওপার থেকে টর্চের আলো আর এপার থেকে আগুন। এই দুই সিগন্যাল একসঙ্গে মিলে গেলেই হাসানরা রওনা দেবে। ওপার থেকেও আসা শুরু হবে। গরু আসবে। আসবে শাড়ি লুঙ্গি আরও কত কি!

বসে থাকতে থাকতে খিদা লেগে গেল হাসানের। মনে পড়ল আজ সন্ধ্যায় তার খাওয়া হয়নি। এক ঝি ঝি পোকার নিরবচ্ছিন্ন ডাকাডাকি ছাড়া চারপাশে কোনো আওয়াজ নেই। এই নৈশব্দের জগতে ক্ষুদাটাই যেন বেশি কানে বাজতে লাগল। ক্ষুধার্ত সময় এই জীবনে নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নয়। তবে এমন চোখ জ্বালাধরা পূর্ণিমার রাতে প্রবল ঠান্ডায় অনিশ্চিত গন্তব্যের অপেক্ষায় থেকে ক্ষুধার্ত হওয়ার অনুভূতি এই প্রথম। পেটের ভিতর পেরেকের আঁচড় টেনে টেনে কেউ যেন বিপ্লবের চিকা আঁকছে!

এই ছেলে! কী যেন নাম?

রাজন হাসান দুইজনই মুখ আগিয়ে দিল প্রশ্ন উত্থাপনকারীর দিকে। হাসানের দিকে মুখ ফিরে প্রশ্ন করায় রাজন মনে করিয়ে দিল হাসানের নাম। হ! হাসান তোমার গা থেইকে এই সাদা চাদরখান খুইলে রাও! যাওন সময় নাইলে চান্দের আলোয় ফকফকা দেখা যাইব দূর থেইকে।

হাসানের মুখটা আরো শুকিয়ে গেল। নাহ! সে বাড়ি ফিরে যাবে। তার আর সীমানা পেরুনো হবে না। এত কষ্ট করে সে যেতে পারবে।

চোখটা যেন এখুনি ভিজে আসবে তার।

সিগনাল মিলছে শেকু বাই! চলো চলো! যেন মুরগি ঘরে তোলার মতো করে তাড়া দিলেন রইছ সবাইকে।

শেকু মামাও দাঁড়ালেন ওঠে কালক্ষেপণ না করে। বোঝা গেল আসলেই একটা তাড়ার বিষয় ঘটেছে।

চল সবাই। রইচ তুই সবার পিছে পিছে আইবি।

প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে শেকু মামা এগিয়ে যেতে লাগলেন।

বাবার পুরনো হয়ে যাওয়া ধূসর সাদা চাদরটা হাসান নিয়ে ছিল। না বলেই। রাজনের ছোট্ট একটা পুঁটলিতে সেটা রাখতে বলল। কিন্তু তাতে এর জায়গা হয় না। এদিকে সময় ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। শেষমেশ চাদরটা পুঁটলির মতো বেঁধে হাসানই রওনা দিল।

এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ কাক্সিক্ষত কিংবা অনাহুত কিনা জানি না। তবে ভাগ্য বিধাতা তার নামের প্রতি সুবিচার করেছিলেন। রাজনরইছরা যখন সীমানা পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে যাচ্ছিল তখনই হঠাৎ প্রচ- সার্চ লাইটের আলো আর বাঁশির ভীতকর আওয়াজ যেন যমদূতের মতো হাজির হলো। ওপারের সীমান্তরক্ষীদের সরব উপস্থিতি, সাতজনের সারিবদ্ধ একটি ছোট দলকে ছত্রভঙ্গ করে দিল। তবুও শেষমেশ ওপারে পৌঁছেছিলেন অনেকেই। কিন্তু শেকু মামা দেখলেন সীমান্ত স্বাপ্নিক এক তরুণ আর তাদের সঙ্গে নেই। এর কিছুদিন পর নিজ দেশে ফিরে রাজন তার বন্ধুকে কোথাও দেখতে পায়নি। তার বাড়ি খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, সেই রাতের পর হাসান আর বাড়িও ফেরেনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর