শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বিজ্ঞাপনে বিশ্বকবি

রণক ইকরাম

বিজ্ঞাপনে বিশ্বকবি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিজীবনে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। কবিতা-গান, গদ্য, নাটক সবকিছুতেই ছিল তাঁর সমান পারদর্শিতা। সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রথম বাঙালি হিসেবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নামডাক। স্বভাবতই সে সময়ে বিশ্বকবির চেয়ে বড় তারকা এই উপমহাদেশে আর কেউ ছিলেন না। কবির তারকা ইমেজ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা কখনো তাঁর ছবি ব্যবহার করে তাঁকে পণ্যের মডেল বানিয়েছেন; আবার কখনো তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছেন পণ্যের গুণগান।  রেল থেকে বিমান, জুতো থেকে সাবান, এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতির ওষুধও- বহু পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবি, মন্তব্য ও উদ্ধৃতি।

 

উপমহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। তাই সারা বছরই দুই বাংলাজুড়ে চলে তাঁকে ঘিরে নানা উৎসব। কয়েক বছর আগে ভারত ও বাংলাদেশে পালিত হয় তাঁর ১৫০তম জন্মজয়ন্তী। সেবার ভারতের একটি আয়োজন সবার দৃষ্টি কাড়ে। কারণ একটাই-এই আয়োজনটি কবি, গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, নাট্যকারসহ অন্যান্য পরিচয়ের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরেকটি নতুন পরিচয় তুলে ধরে সবার সামনে। আর সেটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপন সংশ্লিষ্টতা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নন্দলাল বসু গ্যালারির একটি বিশেষ প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনীতে নানান রূপে আবিষ্কার করা গেছে রবীন্দ্রনাথকে। আবিষ্কার করা গেছে রবীন্দ্রনাথের ‘মডেল’ প্রতিভাও। ওই সময়েই নানা পণ্য ও সেবা ব্যবসার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন ঠাকুরবাড়ির জমিদার রবিবাবু।

এরপর নানা পত্রপত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে বারবারই ঘুরে বেড়িয়েছেন মডেল রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথের লেখা বিজ্ঞাপনগুলো। সেই সময় টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া আর ইন্টারনেট ছিল না, কিন্তু ব্যবসা ছিল। ছিল পণ্যের প্রচার আর  প্রসারের চেষ্টাও। সেই চেষ্টা থেকেই তখনকার ব্যবসায়ীরা দ্বারস্থ হতেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কবির হাতের লেখা, মন্তব্য কিংবা ছবি পত্রিকার পাতা আর পোস্টার ব্যানারে হয়ে উঠত পণ্যের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। রবীন্দ্র গবেষকদের বিভিন্ন লেখায়ও কবির বিজ্ঞাপনী জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। সেখান থেকে জানা যায়, তখন কবি সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি ছিলেন, তাই সবাই তাঁর সান্নিধ্য পেতে চাইতেন। এমনকি ব্যবসায়ীরা পণ্যের প্রসারে কবিকে পেতে চাইতেন। ইংরেজ শাসনামলে চারদিকে বিদেশি পণ্যের জয়জয়কার। সেই জয়যাত্রার সময় ইংরেজরা যাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া বাজার দখল করতে না পারে সেজন্য রবীন্দ্রনাথ নিজেই চাইতেন দেশীয় পণ্যের প্রসার ঘটুক। আর এ কারণেই দেশীয় ব্যবসায়ীদের জন্য বিজ্ঞাপন লিখে দিতেন কবি। এর বাইরে মূলত বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহই ছিল তাঁর বিজ্ঞাপন জগতে আসার কারণ। বিশ ও ত্রিশের দশকজুড়ে বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একচ্ছত্র কপিরাইটার, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ও মডেল। উপমহাদেশে তখন এমন কোনো বনেদি ও বড় প্রতিষ্ঠান ছিল না যেখানে রবীন্দ্রনাথের লেখা বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। ইংরেজি ও বাংলা সব ধরনের কাগজেই ছিল তাঁর উপস্থিতি।

নতুন বই থেকে ইকোমিক কুকার, নানা ধরনের পণ্যে ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখা, অটোগ্রাফ বা তাঁর নিজের ছবি। বিদেশি কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্টতায় আলোচিত বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে রয়েছে

হিন্দুস্তান কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স সোসাইটি লিমিটেড, নেপিয়ার সেন্ট ওয়ার্কার্স, গোদরেজ সাবান, কুন্তলীন চুলের তেল, জলযোগের মিষ্টান্ন, শ্রীঘৃত, বর্ণভিটা, দার্জিলিং চা, বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, বাটা, ভারতীয় রেল, রেডিয়ম ক্রিম, ডোয়ারকিন হারমোনিয়াম, সমবায় বীমা, ছাপাখানা, কটন মিল, ফটো-স্টুডিও, রেকর্ড, বই, কাজল-কালি, পেন্টওয়ার্ক ইত্যাদি। ১৮৮৯ থেকে শুরু করে ১৯৪১, পাঁচ দশক বিস্তৃত সময়ে তিনি প্রায় ৯০টি বিজ্ঞাপনে নিজের মন্তব্য, উক্তি, উদ্ধৃতি, এমনকি ছবিও ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।

এসব বিজ্ঞাপনের একটা বড় অংশ কবির জীবদ্দশায়, তাঁর সম্মতিতে প্রকাশিত। অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, দ্য স্টেটসম্যান, প্রবাসী, তত্ত্ববোধিনী, ক্যালকাটা গেজেট-এ, আর বিদেশে দ্য গার্ডিয়ান, দ্য গ্লোব-এর মতো পত্রিকাতেও। এর বাইরে প্রবাসী, বসুমতি, শনিবারের চিঠি, সাধনা, দেশ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে রবিঠাকুরের বাহারি বিজ্ঞাপন।

কপিরাইটার হিসেবেও অতুলনীয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়ে তাঁর লেখা কিছু কপি দেখলেই এ সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। ওই সময়ে দেশজ কোম্পানির কালি ছিল সুলেখা। যাদের বাজারে বিদেশি কোম্পানি পার্কার ও শেফার্সের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো। রবীন্দ্রনাথ সুলেখা কালির পক্ষে লিখেছিলেন, সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো। সুলেখা নামটিও তাঁর দেওয়া। ডাক্তার উমেশ চন্দ্র রায় নামের একজন ওই সময় তৈরি করতেন পাগলের ওষুধ। ‘পাগলের মহৌষধ’ শিরোনামে এই বিজ্ঞাপনে কবি লিখলেন, “৭০ বছরের ঊর্ধ্ব কাল যাবৎ লক্ষ লক্ষ দুর্দান্ত পাগল ও সর্বপ্রকার বায়ুগ্রস্ত রোগীর আরোগ্য করিয়াছে। মূর্ছা, মৃগী, অনিদ্রা, হিস্টিরিয়া, অক্ষুধা, স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগেও ইহা আশু ফল’প্রদ।” এরপর কবি লিখলেন, ‘আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি।’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।  বলাবহুল্য, সাহিত্যের সব শাখার মতো বিজ্ঞাপনের বাজারেও রবি কবি অপ্রতিরোধ্যই ছিলেন।

 

শর্ত ছিল বিজ্ঞাপনের

পণ্যের বিজ্ঞাপন করার জন্য রবিঠাকুর টাকা নিতেন। তবে সেক্ষেত্রে তাঁর কিছু শর্ত ছিল। প্রথমত পণ্যটি তাঁর মোটামুটি পছন্দ হওয়া চাই। দ্বিতীয়ত বিজ্ঞাপনের কপি রাইটের দায়িত্ব তাকেই দিতে হবে। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ নামটাই বিক্রির জন্য যথেষ্ট। ফলে কেউই এই শর্তে আপত্তি করত না। ফলে রবিবাবুর সব বিজ্ঞাপনের কপিই নিজের লেখা।

ব্লেডের বিজ্ঞাপনে না

একবার কবির কাছে ভারত ব্লেড সংস্থা থেকে লোক এলো বিজ্ঞাপনের মডেল ও কপি লেখানোর জন্য। ব্লেডের কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন। তারপর নিজের দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, এই দাড়ি নিয়ে যদি আমি ব্লেডের বিজ্ঞাপন করি তাহলে কেউ কি ব্লেডের ধারে আস্থা রাখবে? না আমাকে করবে বিশ্বাস?

 

 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বড় তারকা আর কেউ ছিলেন না। ফলে সেই সময়ে নানা পণ্য ও সেবার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন কবিগুরু। নতুন বই থেকে শুরু করে কুকার, তেল, মিষ্টির বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে তাঁকে। এসব বিজ্ঞাপনে কখনো তাঁর স্বাক্ষরসহ আশীর্বাদ বাণী; কখনো অটোগ্রাফ বা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ওপরের ছবিগুলোতে পাগলের মহৌষধ, নেপিয়ার সেন্ট ওয়ার্কস, বাটা, হিন্দুস্তান ইন্স্যুরেন্স, পূর্ব রেলওয়ের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপনের বড় অংশ কবির জীবদ্দশায় প্রকাশিত।  প্রবাসী, বসুমতি, ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, শনিবারের চিঠি, সাধনা, দেশ পত্রিকার পাশাপাশি সে সময়ের বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞাপন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর