শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

লেখালেখির অনুবন্ধ

হোসেন আবদুল মান্নান

লেখালেখির অনুবন্ধ

ছবি : জয়ীতা রায়

লেখালেখির জগতে নতুনদের সব সময় স্বাগতম। আমাদের বইমেলায় তরুণ লেখকদের জন্য পৃথক কর্নার আছে। প্রান্তিক পর্যায় থেকে নবীন লেখক ও সম্পাদকদের সম্পাদনায় বের হওয়া ছোট কাগজের (লিটল ম্যাগ) জন্যও রয়েছে নির্ধারিত স্থান।  বহুকাল আগে থেকেই বাংলা একাডেমি এমন একটা মহত্তম উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। একাডেমি কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের ভাষা আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারক-বাহক আসলে নবীনরা।

 

ফেব্রুয়ারি মাস। এখন বইমেলা চলছে।

এক সময় আমাদের দেশে সারা বছরই বই প্রকাশ হতো। এখনো হয়, তবে একুশের বইমেলা একটা বড় উপলক্ষে পরিণত হয়েছে। এ সময় দেশের পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও লেখক-কবি-সাহিত্যিকের পক্ষ থেকে অব্যাহত চাপ থাকে। তারাও পড়েন দোটানায়, কার লেখাকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় নেবেন বা কাকে নেবেন না। এদিকে নতুন-পুরনো, নবীন-প্রবীণ, পরিচিত-অপরিচিত সব লেখকই বইমেলায় তার লেখা বইটা প্রকাশ করতে চান। সবাই যেন ফেব্রুয়ারির জন্য অধীর হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এ ধারণা এবং প্রবণতা দিন দিনই প্রবলতর হচ্ছে।

তবে প্রকাশিতব্য বইয়ে লেখার বিষয়বস্তু, শ্রেণি, ধরন, মৌলিকত্ব বা নতুনত্ব নিয়ে লেখালেখির জগতে নানা কথা প্রচলিত আছে। কারা লিখছেন, কী লিখছেন, কেন লিখছেন বা লেখার তথ্যসূত্র কী? এসব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত লেখকও মাঝে-মধ্যে উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন। তারা মনে করেন, সবাইকে লিখতে হবে কেন? তাহলে পড়বে কারা?

লেখকের চেয়ে পাঠকের যে বেশি প্রয়োজন। গবেষণায় বলে, দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও নিবিষ্ট পাঠকের সংখ্যা কমেছে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় হার্ডকপির বইয়ের গুরুত্বও ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। লেখালেখিতে কলমের ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। এখন লেখালেখি চলছে এদিক-ওদিক থেকে কাটাকুটির ওপর ভর করে। সংরক্ষিত বাঁধাই করা পুস্তিকার পৃষ্ঠাকে স্পর্শ না করেও পাঠক এবং লেখক উভয়ই হওয়া যাচ্ছে।

কিছু দিন আগের কথা, একজন চাকরিজীবী কবি তার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থখানি স্বউচ্ছ্বাস ও আগ্রহ ভরে তুলে দিলেন একজন প্রতিথযশা বরেণ্য কবিকে। কবি বইটা হাতে নিলেন, একটু নেড়েচেড়ে চোখ বোলালেন। তাঁর চোখে-মুখে প্রচ্ছন্ন বিরক্তির ছায়া। তারপর বেশ রাগতস্বরেই বললেন, ‘আপনি অধ্যাপক, শ্রেণিকক্ষে পড়ানোয় মনোনিবেশ করুন। আপনাকে কে বলেছে কবিতা লিখতে? আপনাকে শিখতে হবে কাব্যের একটা পৃথক ভাষাশৈলী আছে, যা আয়ত্ত করতে হয়, এর বাক্য, শব্দ, ছন্দ ও অনুপ্রাসে ভিন্নতা আছে। এর একটি বৃত্তাবদ্ধ সূত্র আছে। এটা নিরেট গদ্যের মতো নয়। আপনি বরং বুদ্ধদেব বসুর অমুক বইটা পড়ুন তারপর লিখবেন’।

নতুন কবি প্রচ- ধাক্কা খেলেন, তার মন খারাপ হয়েছে এবং বিষণœ বদনে প্রস্থান করেছেন।

নতুনদের এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। প্রথম জীবনে হুমায়ূন আহমেদকেও নাকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নকল করে বড় লেখকের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিতে হয়েছিল। এর ভালো-মন্দের হিসাব কষতে যাচ্ছি না। প্রবীণদের অধিকার আছে নবীনদের প্রারম্ভিক পর্যায়ের লেখা পড়ে এমন হিতৈষী বাণী বিতরণের। তবুও বলব,

ভুল করে করেই সবাই একদিন সব্যসাচী ও প্রাতঃস্মরণীয় হয়েছেন। বিশ্বসাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছেন। এ কথা বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবদ্দশায় তাঁর বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শনে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও কোনো লেখা প্রকাশ পায়নি।

অবশ্য তখনো (১৮৮৩ সালে) রবিঠাকুর কাব্যজগতে খ্যাতিমান ছিলেন এবং অসংখ্য গ্রন্থের লেখক ছিলেন। প্রবীণ বঙ্কিমচন্দ্র হয়তো তখন তাঁকে গুরুত্ব দেননি।

কাজেই আসুক সবাই, কাজ করুক। ডুব দিয়ে থাক বই এবং লেখাজোখার অতলান্ত সমুদ্রে। পড়ার অনিঃশেষ অভ্যাসে প্রবেশ করুক সবাই। লেখা আসলে পড়ার আরেক নাম। পড়ার মধ্যেই লেখকের কাক্সিক্ষত লেখাটা ধরা দেয়। এর একটা অপরিমেয় ভালো দিক আছে। লেখকরা সচরাচর কপট হন না। তাঁদের ভেতরে সার্বক্ষণিক অকপট ভাষ্যকার হওয়ার মানসিকতা কাজ করে। তাঁরা মা, মাটি ও স্বজাতিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেন না। এবং দেখতে পারেন না।

বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখকদের অনেকেই শুরুতে প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বিফল হয়েছেন। অগত্যা তাঁদের লেখা প্রথম বই নিজের টাকায় প্রকাশ করেছেন। আজ প্রকাশকগণ হয়তো তাঁদেরই অগ্রিম সম্মানীর মাধ্যমে নিজের কাছে ধরে রাখছেন। যদিও এঁদের সবাই বাঁধভাঙা পাঠকপ্রিয়তা পাননি। এঁদের অনেক লেখাই আলোর মুখ দেখেনি। অনালোচিত, অনুল্লেখযোগ্য থেকে গেছে। এতে তাঁদের কোনো খেদ নেই, অনুশোচনা নেই। পেছনের দিকে না তাকিয়ে নিঃশঙ্কোচে তাঁরা কেবল

লিখে গেছেন সুন্দর আগামীকালের জন্য। এমনকি লেখার রূঢ় সমালোচনাকেও অনবরত অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন। তাঁরা একের পর এক লিখেছেন ভীষণ সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে। একদিন না একদিন পাঠকরা তাঁকে নিবিড় অভিনিবেশে গ্রহণ করবে, এটা তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।

অসাধারণ জনপ্রিয় এবং একাধিক প্রজন্মকে পাঠে আচ্ছন্ন করে রাখা কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ প্রায় ষাট বছর ধরে লিখেও তৃপ্ত ছিলেন না। আফসোস করে বলেছিলেন, ‘আমার সেরাটা এখনো হয়ে ওঠেনি। মৃত্যুর পরে ১০ বছর পাঠক আমাকে পড়লে তবেই আমি বিশ্বসাহিত্যের অংশ হব’। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয় হলেও প্রসঙ্গ আসলেই তিনি এড়িয়ে যেতেন। বলতেন, ‘এটা আমার কাঁচা হাতের কাজ’।

এখনকার জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনও অর্ধশতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্ন লেখালেখির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এত রচনার পর

আরও ধ্রুপদী, আরও বিশ্বমানের দিকে ধাবমান রয়েছেন তিনি।

৬০ বছরের অধিককাল দু’হাতে লেখার পরও প্রয়াণের কিছুদিন আগে কবি ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, ‘এখনো অপেক্ষায় কত কবিতা কত নাটক কত গল্প। করোটির ভেতর শব্দের কী অবিরাম গুঞ্জন। কলমের গর্ভে

এখনো তো আমার রক্ত অফুরান। দৃষ্টিভূমিতে এই দেশ ও এই মানুষেরই দীর্ঘছায়া লয়ে আমি আমার লেখার টেবিলে।’

লেখালেখি সম্পর্কে নোবেলজয়ী মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ‘ভালো লেখার পথে ‘নোবেল পুরস্কার’ একটা বিরাট অন্তরায়। কেননা এটা পাওয়ার পর কেউ আর মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি’। এর মানে বড় পুরস্কার কখনো কখনো লেখককে অতি আত্মবিশ্বাসী ও দাম্ভিক করে তোলে। যা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তবু সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান প্রাপ্তির কোনো তুলনা হয় না।

লেখালেখির জগতে নতুনদের সব সময় স্বাগতম। আমাদের বইমেলায় তরুণ লেখকদের জন্য পৃথক কর্নার আছে। প্রান্তিক পর্যায় থেকে নবীন লেখক ও সম্পাদকদের সম্পাদনায় বের হওয়া ছোট কাগজের (লিটল ম্যাগ) জন্যও রয়েছে নির্ধারিত স্থান।  বহুকাল আগে থেকেই বাংলা একাডেমি এমন একটা মহত্তম উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। একাডেমি কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের ভাষা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারক-বাহক আসলে নবীনরা। কারণ, এই পৃথিবী শেষ পর্যন্ত তরুণদের হাতেই।

লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর