গত দেড় বছরে আমি অন্তত তিনবার কলকাতা গিয়েছি। সে সময়ে ভারতের আরও দু’চারটি রাজ্যে যাওয়া হলেও ঘুরেফিরে শেষ ঠিকানা বাঙালির ইতিহাসের আদি শহর কলকাতায় দুয়েক দিন থাকতেই হয়েছে। আমার কাছে কলকাতা মানে জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনের পরে কলেজ স্ট্রিটে একটু ঘোরাঘুরি করে আসা, কফি হাউস, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, আনন্দ ও দে’জ পাবলিশার্সসহ বিভিন্ন প্রকার বইয়ের দোকানে উঁকি দিয়ে আসা। অন্যথায় ওপার বাংলার সফরটাই যেন অসম্পূর্ণ অসমাপ্ত থেকে যায়।
চলতি বছরের জুলাই মাসেও কলকাতা গিয়ে একইভাবে সবান্ধব বই পাড়ায় ঘুরতে যাই। মোটামুটি চোখে পড়ার মতো স্টলগুলোয় প্রবেশ করেছি। মনে হয়েছে, বাংলা বা ইংরেজিতে ছাপা নব্বই ভাগ বই-ই কলকাতা থেকে প্রকাশিত। তাছাড়া প্রকাশনার ভুবনে কলকাতার জুড়ি মেলা ভার। একই সাথে বাংলাদেশের কবি লেখকদের বই এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে একটু পরখ করারও চেষ্টা করি। বলাবাহুল্য, হাতের নাগালে বা ওপরের সারিতে রাখা বইয়ের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আমাদের এখানকার অন্য কোনো লেখকের বই শোভা পেতে অন্তত আমি দেখিনি। এর অর্থ এই নয় যে, অন্যদের বই পাওয়া যাবে না। খোঁজ নিলে হয়তো পাওয়া যেত। দু’একটা দোকানে নবীন কথাসাহিত্যেক সাদাত হোসাইনের বই দেখা গেছে। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের পাইরেসি চলেছে বলেও তারা জানান। ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায় যেমন পৃথিবীর বিখ্যাত বইয়ের ফটোকপি ভার্সন উন্মুক্ত রাস্তায় বা দোকানে পাওয়া যায়, তেমনি কলকাতায় হুমায়ূনের বই পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ে তাঁর ‘হিমুসমগ্র’, মধ্যাহ্ন, কবি, ‘এইসব দিনরাত্রি’ ইত্যাদি। তবে কেউ কেউ সাদাত হোসাইনেরও প্রশংসা করলেন।
২.
কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তে প্রথম জীবনে আমি নিজেও খুব বেশি আগ্রহী ছিলাম না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অবধি আমার মনে একটা বদ্ধমূল নেতিবাচক ধারণা জন্মেছিল যে, ওনার লেখাগুলো নাকি কেবল কোমলপ্রাণ বাচ্চাদের জন্য। অথচ গোটা আশির দশকে বাংলা একাডেমি চত্বরের জনারণ্য বইমেলায় প্রায় প্রতিদিন ঘুরতে গিয়েছি এবং দেখেছি- যে স্টলটির সামনে শহুরে তরুণ-তরুণীদের ভিড় লেগে আছে, সেখানেই হুমায়ূন আহমেদ। মাথা নিচু করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অটোগ্রাফের কলমের আঁচড়ে পালকের চিহ্ন রেখে যাচ্ছেন। মনে পড়ে অটোগ্রাফের জন্য না হলেও ভিড় ঠেলে দু’একবার আমিও তাঁকে দেখেছিলাম। নব্বইয়ের দশকে এসে অটোগ্রাফ শিকারি জনতার ভিড় ঠেকাতে বইমেলায় পুলিশ মোতায়েন করতে আমরা সবাই দেখেছি। এমনকি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে নিতে হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তার ঝুঁকি।
৩.
আমার বলতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা নেই যে, মাত্র দুটি ছোট্ট লেখা পড়ে বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আমার মনোজগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সালের সময়ে বিকাল হলে প্রায়ই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যেতাম। আমি তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মায়া ছাড়তে পারিনি। সেখানে যাওয়ার মূল আকর্ষণ পণ্ডিত অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ। উদ্যানে এক ঘণ্টা হাঁটার পরে তিনি তাঁর সাগরেদদ্বয় অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক এবং অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদারকে নিয়ে গোল চক্করে বসেন। খোলা আকাশের নিচে চলে দীর্ঘক্ষণ মুক্ত আলোচনা। শ্রোতারা বেশির ভাগই ছাত্র ও শিক্ষক। অধ্যাপক ও লেখক হুমায়ুন আজাদও মাঝেমধ্যে শ্রোতাদের দলে থাকতেন। আলোচনার প্রসঙ্গের কোনো নির্ধারিত স্থান-কাল-পাত্র ছিল না। যে কেউ প্রশ্ন করলে ড. আহমদ শরীফ অকপটে ও অসংশয়ে উত্তর দিতেন। তিনি কখনো কাউকে পরোয়া করে কথা বলতেন না। সত্য বলার এমন সাহসী মানুষ আজকের দিনে বিরল। সেই সময়ে সম্ভবত কারও প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আহমদ শরীফ হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। বরং ইতিবাচক সাড়া দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে জানতে পারি, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’র ভূমিকা লিখেছেন আহমদ শরীফ নিজে। তাঁর সেই অভূতপূর্ব সংক্ষিপ্ত ভূমিকা পড়েই ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকি।
দ্বিতীয় বিষয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের চোখে তাঁর নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প সংকলন। এতে হুমায়ূন আহমেদের ‘চোখ’ ছোটগল্পটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সৈয়দ হক হুমায়ূন আহমেদকে দেশের অন্যতম সেরা একজন গল্পকারও বলেছিলেন। তবে এখন মনে নেই কোথায় পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, উল্লিখিত যে দু’জন বিখ্যাত লেখক জীবনে সহজে কারও গুণকীর্তন বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে জানতেন না, তাঁরা যদি হুমায়ূন আহমেদের ভূয়সী প্রশংসা করতে পারেন, তবে আর কিছুর কি প্রয়োজন আছে?
৪.
অধ্যাপক আহমদ শরীফ ১৯৭২ সালে ‘নন্দিত নরকে’র ভূমিকার দ্বিতীয় প্যারায় লিখেছিলেন, ‘পড়ে আমি অভিভূত হলাম। গল্পে সবিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর, একজন কুশলী স্রষ্টার পাকা হাত। বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এক সুনিপুণ শিল্পীর এক দক্ষ রূপকারের, এক প্রজ্ঞাবান দ্রষ্টার জন্মলগ্ন যেন অনুভব করলাম।’ আমাদের সাহিত্যের অর্ধশতাব্দীর ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে। ড. আহমদ শরীফের ভবিষ্যৎদ্বাণী যথার্থ ছিল।
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি, নিঃসঙ্গ শেরপাখ্যাত শামসুর রাহমান বলেছেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ অনেকগুলো উপন্যাস রচনা করেছেন এবং ইতিমধ্যে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তা সম্পর্কে কারও কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় এবং কেউ কেউ বাঁকা উক্তিও করে ফেলেন। কিন্তু দেখা গেছে অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থশ্রেণীর লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি, সন্দেহ নেই, বিশাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, যা সাহিত্যের পক্ষে উপকারী। এ কথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে, তিনি, ভবিষ্যতে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে কিংবদন্তির মর্যাদা পাবেন।’
৫.
যেসব বই পড়ে আমি ভক্ত হয়ে পড়ি বা তাঁর প্রতি অনুরাগী হই এর দু’চারখানা উল্লেখ করা যায়।
২০০৪ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। যা আমাকে প্রথম মুগ্ধ করে তোলে। এতে অন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে, এর চরিত্র ও স্থানগুলো আমার নিজের জন্মভূমির কাছাকাছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত সুন্দর নিখুঁত বয়ান খুব বেশি দেখা যায় না। তাঁর চরিত্র চিত্রণেও ময়মনসিংহ এলাকার ভাষা, সংস্কৃতি তথা গ্রামীণ আবহ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
একে একে পড়ে নিই, বাদশাহ নামদার, মধ্যাহ্ন, দেয়াল,
মাতাল হাওয়া, কবি, নন্দিত নরকে, গৌরীপুর জংশন, নি, কাঠপেন্সিল, বলপয়েন্ট ইত্যাদি। তাঁর আরও কিছু বই হাতের নাগালে আছে। এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। বাদশাহ নামদার পড়েও বিমোহিত হই। যেন ঘোরলাগা এক মায়াজালে আটকে যাই। মনে হয়, তিনি ইতিহাসের প্রাজ্ঞ একজন শিক্ষক বা ইতিহাসবিদ গবেষক। বইটি পাক-ভারতের ইতিহাসের শিক্ষকদের অবশ্যই পাঠ করা উচিত।
৬.
মাত্র ৬৩ বছরের জীবনকালে নিরঙ্কুশ বিজ্ঞানপড়ুয়া হুমায়ূন সৃষ্টি করে গেছেন বিচিত্র সব মানবচরিত্র। লেখালেখি নিয়ে তাঁর ক্লান্তি বা একগুঁয়েমির কথা কখনো শোনা যায়নি। তিনি বলতেন, ‘অনেক লেখকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়েছে। তবে আমার বেলায় তা হয়নি বরং লেখার আগ্রহ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে’। তাঁর নিরন্তর সৃজনশীলতার ভান্ডার ছিল বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক। উপন্যাস, গল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, জীবনীগ্রন্থ, নাটক, রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান, শিশুতোষ, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ, গান বা গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা- সব জায়গায় দারুণ সফল হয়েছেন তিনি। এই প্রতিভাবান বাঙালি শেষ সময়ে এসে ছবি আঁকা নিয়েও ব্যস্ত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, তাঁর ‘এইসব দিনরাত্রি’, অয়োময় বা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকগুলো কালোত্তীর্ণ হয়ে আজও দর্শকের হৃদয় জয় করে আছে। চলচ্চিত্রগুলোও অনাগত কালের স্মৃতির আর্কাইভে সংরক্ষিত থাকবে। প্রায় তিন শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। বইয়ের নামকরণ বিষয়েও তাঁর একটা নিজস্ব ঘরানা ছিল। যদিও বলেছেন, ‘অনেক নাম তিনি কবিদের কাছ থেকে ধার করেছেন’। আরও বলেছেন, ‘বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখকরা আবেগের বাড়াবাড়ি করেন’। তবু তাঁর উৎসর্গপত্রে উৎকীর্ণ অসাধারণ বাক্য বা বাক্যসমূহ যে কোনো পাঠককে শুরুতেই আকৃষ্ট করে তুলতে পারে। বলা যায়, এটাও ছিল হুমায়ূন আহমেদের পাঠক ধরার এক অভিনব অনন্য স্টাইল।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        