শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অগ্নিকান্ডে প্রাণ বাঁচাবে জাকারিয়ার যে যন্ত্র

♦ আগুনের উৎস ও অবস্থান নিশ্চিত করবে এবং অ্যালার্ম বাজবে ♦ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অগ্নিস্থলে পানি বা গ্যাস প্রয়োগ করবে ♦ আগুনের উৎস ও অবস্থান সুনিপুণভাবে ভবন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট জরুরি সেবাদাতাদের এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে

জামশেদ আলম রনি

অগ্নিকান্ডে প্রাণ বাঁচাবে জাকারিয়ার যে যন্ত্র

ব্যক্তিগত ল্যাবে ডিভাইসটির উন্নয়নে কাজ করছেন প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া

‘নির্বানল-৭১’ একটি ওয়েব বেজড মনিটর সিস্টেম যেখানে সার্বক্ষণিক রুমের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ধোঁয়া, কারেন্ট ও ভোল্টেজ পর্যবেক্ষণ করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম  বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আগুন নিয়ন্ত্রণ করবে ‘নির্বানল-৭১’ নামের ডিভাইসটি...

 

অগ্নিকান্ড বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আগুন লেগে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের প্রভূত ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এটি থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে কাজ করছেন অনেকেই। অগ্নিকান্ড ঘটলে তা মোকাবিলার ব্যবস্থা প্রতিটি ভবনেই গড়ে তোলা দরকার। ‘নির্বানল-৭১’ একটি ওয়েব বেজড মনিটর সিস্টেম যেখানে সার্বক্ষণিক রুমের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ধোঁয়া, কারেন্ট ও ভোল্টেজ পর্যবেক্ষণ করবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আগুন নিয়ন্ত্রণ করবে ‘নির্বানল-৭১’ নামের ডিভাইসটি। নির্বানল-৭১ ডিভাইসটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। যেখানে চারটি ধাপ থাকবে। প্রথমত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বা গ্যাস প্রয়োগ করবে। দ্বিতীয়ত, অ্যালার্ম বাজবে, তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এসএমএস করবে এবং ওয়েব মনিটরে রুমের পরিবেশের অবস্থা দেখাবে; যা কর্মস্থলের বা বাড়ির পরিবেশ পর্যবেক্ষণ ও অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। এর মাধ্যমে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অর্থায়নে ‘নির্বানল-৭১’ ডিভাইসটি তৈরি করেছে প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া ও তার দল। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডের পরে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নকালে ‘নির্বানল-৭১’ নিয়ে গবেষণা কাজ শুরু করেছিলেন প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এই ডিভাইসটি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আয়ের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছেন তিনি।

‘নির্বানল-৭১’ এর উদ্ভাবক প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অগ্নিকান্ডের উৎস যদি শর্টসার্কিট হয় তাহলে নির্বানল-৭১ ডিভাইসটি সুনির্দিষ্টভাবে সেই রুমের বিদ্যুৎ বন্ধ করবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি বা গ্যাস প্রয়োগ করবে, আলার্ম বাজবে এবং ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, বিদ্যুৎ ও ভবন কর্তৃপক্ষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট স্থানের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে এসএমএস করবে। (যেমন- আগুন!!! দক্ষিণ বাড্ডা দারোগাবাড়ী মোড়, নূর মঞ্জিল, ৫/বি, রুম নং-০৫)।

তবে শর্টসার্কিট থেকে যদি আগুন কিংবা ধোঁয়া না পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সে এসএমএস যাবে না। অগ্নিকান্ডের উৎস যদি প্রাকৃতিক হয়, তাহলে ভবনের কোনো রুমে ধোঁয়া, অতিরিক্ত তাপমাত্রা এবং কম আর্দ্রতার সৃষ্টি হলে সুনির্দিষ্টভাবে সেই রুমের বিদ্যুৎ বন্ধ হবে, পানি বা গ্যাস প্রয়োগ করবে, অ্যালার্ম বাজবে এবং ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, বিদ্যুৎ ও ভবন কর্তৃপক্ষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট স্থানের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে এসএমএস করবে। প্রকৌশলী জাকারিয়া আরও বলেন, ‘আমরা আপডেট একটা ভার্সন নিয়ে আসতে যাচ্ছি, যেখানে ডিভাইসটিতে ক্যামেরা সংযুক্ত থাকবে। অনেক সময় দেখা যায় ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। সে ক্ষেত্রে ক্যামেরার মাধ্যমে আমরা ওই ব্যক্তিকে সহজেই শনাক্ত করতে পারব।’

জাকারিয়া জানান, ‘বাংলাদেশে প্রায়শ বহুতল ভবন, শিল্পকারখানা এবং গুদামঘরে আগুন লেগে থাকে যার উৎস এবং অবস্থান জানতে অনেক সময় লাগে বিশেষ করে অবস্থান খুঁজে বের করার আগেই আগুন বহুদূরে ছড়িয়ে যায় এবং ব্যাপকতা লাভ করে যা নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রাণ হারানোসহ ক্ষয়ক্ষতি হয় সম্পদের। ‘নির্বানল-৭১’ ডিভাইসটি দিয়ে আমরা অগ্নিকান্ডের আগেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারছি। ফলে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হওয়ার শঙ্কা থাকছে না।’

ডিভাইসের অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিভাইসটি বর্তমানে প্রোডাক্ট হিসেবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। খুব দ্রুতই বাণিজ্যিকভাবে ডিভাইসগুলো বাজারজাত করব। ডিভাইসটির দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১ হাজার স্কয়ার ফিটের রুমে দুটি ডিভাইসের দাম পড়বে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। ৫ হাজার স্কয়ার ফিটের রুমে দেড় থেকে ২ লাখ টাকা পড়বে ডিভাইস সেটআপে। এর সঙ্গে আলাদা কিছু সরঞ্জাম আছে। যেমন- আউটলেটের কিছু পাইপ টানতে হবে সেগুলোর মূল্য ধরা হয়নি।’ প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া আরও জানান, ‘অগ্নিজনিত দুর্ঘটনা আমাদের দেশের একটি জাতীয় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আমি উদ্ভাবন করেছি ‘নির্বানল-৭১’। একটি কাজ করতে হলে সবার আগে ইচ্ছাশক্তি ও অর্থ দরকার। আইসিটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের এক অভাবনীয় পরিকল্পনা হলো উদ্ভাবনী বৃত্তি। যার ফলাফল আজকের এই প্রজেক্ট। আমি মন্ত্রী, সচিব এবং বৃত্তি শাখার সবার কাছে কৃতজ্ঞ যাদের কারণে আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।’

মো. জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আরও বলেন, ‘ডিভাইসটি আমেরিকান ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অথরিটির (এনএফপিএ) স্ট্যান্ডার্ড মেনে তৈরি করা হয়েছে।  এটি এসডিজির ৯.৫ শর্ত পূর্ণ করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের চতুর্থ পিলার আইটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশনের শর্তও পূরণ করেছে এটি।  এর মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়ার বীজ বপন করা হয়েছে।’

সর্বশেষ খবর