মো. রফিকুল ইসলাম সোহেল। উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। ভরাট গলা। আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী। বসে থাকলে তাকে স্বাভাবিক মানুষই মনে হবে। তবে বলিষ্ঠ মানুষটির কোমর থেকে নিচের অংশ দুর্ঘটনায় অচল। শরীরে অর্ধেক হয়ে যাওয়া মানুষটি কাজকর্মে পূর্ণাঙ্গ মানুষকেও ছাড়িয়ে যান। যিনি অন্যের সহযোগিতা ছাড়া গোসলসহ অন্যান্য কাজ করতে পারেন না, তিনি বই নিয়ে ছুটছেন বিভিন্ন সেলুনে। নগরীর বিভিন্ন কার্যক্রমে হুইল চেয়ার নিয়েই উপস্থিত হন। ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেন হুইল চেয়ারে বসেই। তার জীবনযাপন ও পথচলা অনেকে অবাক দৃষ্টিতে দেখেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রফিকুল ইসলাম সোহেলের বাসা কুমিল্লা নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুর। ডা. মো. ইদ্রিস মিয়া ও রাবেয়া খানমের চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সোহেল ষষ্ঠ। তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কুমিল্লা জেলা দল, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় দল ও ঢাকা প্রথম বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। দুর্ঘটনার আগে কুমিল্লা ইপিজেডের একটি কোম্পানিতে মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করতেন। ২০১৪ সালে মোটরসাইকেলযোগে ইপিজেডের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে অটোরিকশার সঙ্গে দুর্ঘটনায় আহত হন। তার মেরুরুজ্জু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে স্থায়ীভাবে স্বাভাবিক চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ঢাকা সিআরপি, কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টারের চিকিৎসা ও পরামর্শ তাকে পুনরায় সচল হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়।
সরেজমিন নগরীর দ্বিতীয় মুরাদপুরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে বসে ল্যাপটপে কাজ করছেন রফিকুল ইসলাম সোহেল। দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি অসুস্থ। হুইল চেয়ার নিয়ে পাশে হাউজিং গোল মার্কেটে যান সেলুনে বই দিতে। তার এক ঊরুর ওপর বই অন্যটির ওপর ইউরিন ব্যাগ। দুই হাতে ঘুরাচ্ছেন হুইল চেয়ার। পথে মানুষের কুশল জানতে চাইছেন, মানুষও হাসিমুখে কথা বলছেন। আলোকিত বজ্রপুর সংগঠনের হয়ে তিনিসহ অন্যরা এ রকম সাতটি সেলুনে বই দেন। আরও আটটি পাঠাগার গড়ে তোলার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। হাউজিং গোল মার্কেট এলাকার সুপার হেয়ার কাটিং সেলুনের পরিচালক সুজন চন্দ্র শীল বলেন, তিনি আমাদের এখানে হুইল চেয়ারে চড়ে বই দিতে আসেন। অবসরে কাস্টমাররা বই পড়ে খুশি হন।
সেলুনের গ্রাহক স্থানীয় ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, এখানে ৪০ বছর ধরে ব্যবসা করি। সুস্থ ও অসুস্থ দুইভাবেই সোহেলকে দেখেছি। তবে অসুস্থ হওয়ার পরও তার কাজের গতি কমেনি। এটা সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
রফিকুল ইসলাম সোহেল বলেন, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রথম ধাপের শুরু নিজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা কার্যক্রমকে দেখভাল করার মাধ্যমে। দ্বিতীয় ধাপে হুইল চেয়ার নিয়ে ঘর থেকে বের হতে তাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জোগায় আলোকিত বজ্রপুর সংগঠন। এই সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী মাসুদ রানা চৌধুরী, ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর, সুমন ও রুবেল পাল সাংগঠনিক কার্যক্রমে তাকে সম্পৃক্ত রেখে এগিয়ে আসার সুযোগ করে দেন। তৃতীয় ধাপে ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোকসানা ফেরদৌস মজুমদার, সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের বোলিং কোচ মাহবুব আলী জাকি, গবেষক অ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক ব্যক্তিগতভাবে তাকে উজ্জীবিত করেন। মাসুদ রানা চৌধুরী বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি সুস্থ মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন।