মঙ্গলবার, ২৩ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

যুগান্তকারী অর্জন পাটের জিন আবিষ্কার

প্রতিদিন ডেস্ক

যুগান্তকারী অর্জন পাটের জিন আবিষ্কার

পাটের জীবনরহস্য বা জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করে পাটকে শুধুই বাংলাদেশের করে দিয়েছেন একদল বিজ্ঞানী। এর মাধ্যমে শুরু হয়েছে সোনালি আঁশ পাটের নতুন স্বপ্নযাত্রা। জিনোম হলো প্রাণী বা উদ্ভিদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এ নকশার ওপরই নির্ভর করে প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। গবেষণাগারে এ জিনবিন্যাস অদলবদল করে উন্নত জাতের পাট উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এ কারণেই পাটের জিনোম সিকোয়েন্সকে পাটের জীবনরহস্য বলা হয়। জীবনরহস্য উন্মোচনের পর বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাটের গুণগত মান ও উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব চেষ্টা সফল হলে পাট পচাতে কম সময় লাগবে এবং পাটের জৈব জ্বালানি তৈরি করা সম্ভব হবে। উদ্ভাবন করা যাবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রয়োজন অনুযায়ী পাটের নতুন জাত। বিশ্বে যে দেড় ডজন উদ্ভিদের জীবনরহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়েছে, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশেরও। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে চীন ধানের এবং মালয়েশিয়া রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল কোনো দেশের বিজ্ঞানীদের এ সাফল্য যে বড় অর্জন তার স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্লাটফরম থেকে। পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম। আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়। অবশ্য বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম এর আগে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পেঁপে ও ২০০৯ সালে মালয়েশিয়া সরকারের হয়ে রাবারের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। মাকসুদুল আলম কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেই গল্পটা জেনে নেওয়া যাক। ২০০৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে মাকসুদুল আলমকে দেশে এসে গবেষণার অনুরোধ জানানো হয়। ২০১০ থেকে ঢাকায় পুরোদমে শুরু হওয়া গবেষণায় সে বছরই সাফল্য আসে। সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সাফল্যের কথা জানান দেশবাসীকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সংস্থা ডাটা সফট যৌথভাবে গবেষণার কাজটি করেছে। গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়ার কাছ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুজীব বিভাগের ১১ জন গবেষক ও ডাটা সফটের ২০ জন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ প্রায় দুই কোটি তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজগুলো করেছেন। শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও ডাটা সফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব জামান তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কাজগুলো তত্ত্বাবধান করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে পলিথিন, প্লাস্টিক ও কৃত্রিম তন্তুজাত পণ্যের ব্যবহার কমে আসছে। প্রাকৃতিক আঁশের পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে সব জায়গায় একই রকম উন্নতমানের পাট উৎপাদনের উপযোগী জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে। এর আঁশ দিয়ে কাপড় তৈরির উপযোগী মিহি সুতাও তৈরি করা যাবে।

 

একজন . মাকসুদুল আলম

ড. মাকসুদুল আলম ছিলেন একজন বাংলাদেশি জিনতত্ত্ববিদ। তার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের একদল উদ্যমী গবেষকের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের মাঝামাঝি সফলভাবে উন্মোচিত হয় পাটের জিন নকশা। ২০১০ সালের ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। তিনি ফরিদপুরে ১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্মেগ্রহণ করেন। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে স্বাধীনতার পর মাকসুদুল আলম চলে যান রাশিয়ায়। সেখানে অণুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে জার্মানিতে বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৭ সালে প্রাণরসায়নে আবারও পিএইচডি করেন। তিনি ২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য ২০১৬ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক অর্জন করেন। ড. মাকসুদুল আলম বাংলাদেশের ইতিহাসে গর্বের এক নাম। জীববিজ্ঞানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তাঁর গবেষণা ও উদ্ভাবন দিয়ে সারা বিশ্বের কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। তিনটি উদ্ভিদ ও ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে তিনি স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বের সেরা কিছু বিজ্ঞানীর তালিকায়।

পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের পর অধ্যাপক ড. মাকসুদুল আলম না- ফেরার দেশে চলে গেলেও থেমে নেই পাট নিয়ে গবেষণা। তাঁর দেখানো পথে জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তোষা ও দেশি পাটের চারটি জাত উদ্ভাবন করেছেন তাঁর অনুসারীরা। এসব জাতের পাটের ফলন প্রচলিত জাতের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। লবণসহিষ্ণু পাট গত বছরই জন্মেছে এ দেশে। আর মাকসুদুল আলমের জিনোম সিকোয়েন্সের স্বীকৃতি, অর্থাৎ মেধাস্বত্ব পাওয়ার খবরও নিশ্চিত হয়।

সর্বশেষ খবর