কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গ্যালারির সব টিকিট বিক্রি শেষ। এতেই বোঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশ বনাম হংকং চায়না ফুটবল ম্যাচে উপচে পড়া ভিড় হবে। এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে হয়েছেও তাই। রাত ৮টায় গুরুত্বপূর্ণ খেলাটি শুরু হলেও বিকাল ৪টার মধ্যে গ্যালারি পূর্ণ। ফুটবল ইতিহাসে ঢাকায় এমন দৃশ্য নতুন নয়। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক লড়াইয়ে পঞ্চাশের দশক থেকে দর্শক উন্মাদনায় মাতছে। ফুটবল বাঙালির মনের ও প্রাণের খেলা। এখানে দর্শক হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই চেনা দৃশ্য যেন হারিয়ে গিয়েছিল। মান ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চরম অবনতি হওয়ায় দর্শক স্টেডিয়ামমুখী হতো না। মোহামেডান-আবাহনীর লড়াই মানে পুরো দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া। এখন দেশের বিখ্যাত দুই দলের ম্যাচেও বেহাল দশা।
এমন দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটায় বসুন্ধরা কিংস। ২০১৮-১৯ মৌসুমে পেশাদার ফুটবলে দলটির অভিষেক হয়। শুরু থেকে মানসম্পন্ন খেলা খেলে তারা দর্শক টানতে সক্ষম হয়। বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনা (স্টেডিয়াম) তাদের হোম ভেন্যু হওয়ার পর তো ফুটবলে সুখস্মৃতি ফিরতে শুরু করে। কিংস অ্যারিনায় বসুন্ধরার খেলা মানেই গ্যালারি দর্শকপূর্ণ। এ শুধু মানসম্পন্ন খেলার জন্য নয়, সৌন্দর্য ও আধুনিকতার কারণে দর্শক টানতে সক্ষম হচ্ছে কিংস অ্যারিনা। ঘরোয়া আসর তো আছেই, উপমহাদেশের একমাত্র নিজস্ব ভেন্যু হিসেবে কিংস অ্যারিনায় ফিফাস্বীকৃত আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের ও এএফসি কাপে কিংসের প্রতিটি ম্যাচে উপচে পড়া দর্শকের সমাগম ঘটেছে। অল্প দিনের মধ্যে দেশের ফুটবলে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে কিংস অ্যারিনা। শুধু গতকালের বাংলাদেশ-হংকং ম্যাচ নয়, এর আগে একই আসরে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষেও ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভরে গিয়েছিল। দুটি ম্যাচেই সেকালের উন্মাদনা ফিরে এসেছে। তাহলে কি জাতীয় দলের মানের উন্নয়ন ঘটায় গ্যালারি ভরছে? না, বাংলাদেশের মানের আহামরি পরিবর্তন ঘটেনি। বলা যায় ব্যর্থতার বৃত্তে এখনো বন্দি। তাহলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব টিকিট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কেন? এখানে কোনো ম্যাজিক কাজ করছে? ম্যাজিক তো বটেই, তবে তা হামজা দেওয়ান চৌধুরীকে ঘিরে। জামাল ভূঁইয়া, তারিক কাজী ও কাজিম শাহ আগে থেকেই প্রবাসী ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দলে খেলছেন। সম্প্রতি যোগ হয়েছেন হামজা, সামিত, ফাহমিদুল ও সর্বশেষ জায়ান আহমেদ। তবে এর মধ্যে প্রধান আকর্ষণ হামজাই। তিনি বাংলাদেশি ফুটবলপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের ফুটবলারের মধ্যে হামজা এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম।
সেকালের ফুটবলেও বাংলাদেশের মান ছিল নিচের দিকে। ছিলেন না কোনো হামজা মানের প্রবাসী ফুটবলার। তার পরও ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে উপচে পড়া দর্শক হতো। তবে জনপ্রিয় কেউ ছিলেন না তা কিন্তু নয়। বরং তখন ছিল তারকা ফুটবলারের ছড়াছড়ি। পিন্টু, টিপু, আবদুস সাদেক, প্রতাপ, সালাউদ্দিন, চুন্নু, শান্টু, হাফিজ, টুটুল, আসলাম, কায়সার, মোনেম মুন্না, সাব্বির এঁদের তো সেকালেই বলা যায়। এঁদের মনোমুগ্ধকর পারফরম্যান্স তো ছিলই, সংগঠকদের দক্ষতার কারণে ফুটবল ছিল উৎসবময়। মোহামেডান-আবাহনী, আগা খান গোল্ডকাপ, ফেডারেশন কাপ বা জাতীয় দলের খেলায় দর্শক হওয়ার পেছনে সংগঠকদের ক্যারিশমা কাজ করেছিল। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব ফুটবল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অথচ এ টুর্নামেন্ট ঘিরে কি যে উন্মাদনা ছিল তা ভোলার নয়। এখনো সেই টুর্নামেন্টে খেলা ইরাকের সুদর্শন হারিস মোহাম্মদের নাম মুখে মুখে। তাঁকে ঘিরে মেয়ে ভক্তদের কাণ্ডের কথা কি মনে নেই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার ও রোকেয়া হলে রুমে রুমে হারিসের পোস্টার লাগানো হতো। যোগ্য সংগঠক থাকলে সবই সম্ভব।
১৯৮৫ সালে সাফ গেমসের ফুটবল ফাইনাল, ১৯৭৭ সালে ইরান-ভারতের ফাইনাল বা ১৯৮৯ সালে মিরপুরে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের ফাইনাল বা এশিয়ান ক্লাব কাপে ইরানের পিরুজি ও মোহামেডানের খেলায় যে দর্শক হয়েছিল তা তো ইতিহাস। এখনো ফুটবলপ্রেমীরা মনে রেখেছেন ইরানের সফেরুদ ক্লাবের আদনান দারজাদ ও অল ইন্ডিয়া দলে খেলা গুরুদেব সিংয়ের নাম। কিংবা ১৯৭৬ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফাইনালে খেলা মালয়েশিয়ার পেনাং ক্লাবের তিন ভাই আবুবকর, মুসাবকর ও ইসাবকরের নাম। সুতরাং দর্শক টানতে শুধু মানসম্পন্ন খেলোয়াড় নয়, সংগঠকদের দক্ষতাও দরকার।
এখন যতটা জেগেছে তা হামজার কল্যাণে।