মঙ্গলবার, ২৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

গাছ কাটা হলে সারা, ধেয়ে আসবে তীব্র খরা

ঢাকায় যেটুকু সবুজ রয়েছে, সেখানেও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বারবার আঘাত করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা। ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত নগরীতে

হাসান ইমন

গাছ কাটা হলে সারা, ধেয়ে আসবে তীব্র খরা

রাজধানীতে সম্প্রতি তাপমাত্রায় রেকর্ড ভেঙেছে। গত ১৫ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি। যা গত ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। একই সঙ্গে গত দুই মাস ৩৮-৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা ঘুরপাক খাচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। একই সঙ্গে নগরীতে জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ও সবুজ কমে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে খরা। এই তীব্র খরায় বাড়ছে দাবদাহ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্ন্তজাতিক মানদন্ড অনুযায়ী একটি আদর্শ নগরে সবুজায়ন থাকার কথা ২০-২৫ শতাংশ। অথচ রাজধানী ঢাকায় সবুজায়নের উপস্থিতি ৭-৮ শতাংশ। সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি বছরে সবুজায়ন বৃদ্ধি হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো দিন দিন কমছে এর পরিমাণ। যা নগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।

‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে গত বছর একটি গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ। তাতে দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বার্ষিক ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সবুজ এলাকা হারিয়েছে ঢাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকা একসময় সবুজহীন মরুময় নগরে পরিণত হবে।

ঢাকায় যেটুকু সবুজ রয়েছে, সেখানেও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বারবার আঘাত করছেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা। ফলে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা। ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে উত্তপ্ত নগরীতে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সম্প্রতি ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোড, শহীদ ফজলে রাব্বি পার্ক, আজিমপুর কলোনি, মোহাম্মদপুর সরকারি কোয়ার্টার, কল্যাণপুর সরকারি কোয়ার্টার, মিরপুর-৬ সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ প্রকল্প, আগারগাঁও সড়ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, ফার্মগেটের আনোয়ার পার্ক, মেট্রোরেলের আশপাশের সড়ক, উত্তরা ও শ্যামলী পার্কের অনেক গাছ কাটা পড়েছে।

 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০১৯ সালের এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট আয়তনের ৯ দশমিক ২ শতাংশ। গাছপালা থাকা এলাকার হিসাব করলে এটি আরও অনেক কম হবে। শহরটির মোট আয়তনের মধ্যে ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশই কংক্রিট আচ্ছাদিত। বাকি এলাকার মধ্যে ৯ দশমিক ২ শতাংশ সবুজ আচ্ছাদিত, ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান এবং ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ জলাভূমি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, যেসব কারণে সবুজ রূপ হারাচ্ছে ঢাকা, তার মধ্যে অন্যতম অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ইমারত ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সবুজের ওপর গুরুত্বহীনতা, কংক্রিটের পরিমাণ বৃদ্ধি, উন্মুক্ত স্থান ও জলাভূমি ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এবং প্রাকৃতিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি। এ ছাড়াও নগরবাসীর সীমাহীন লোভ ও কংক্রিটের শোভাবর্ধনের কারণেও সবুজ ঢাকা ক্রমেই ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে এক সময়ের গাছপালায় ঘেরা ও সবুজে আচ্ছাদিত ঢাকার নির্মল বায়ু পরিণত হচ্ছে দূষিত বায়ুতে। যা এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে প্রতিনিয়ত। ঢাকার দুই সিটিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এদিকে নজর দেওয়া জরুরি। না হয় পরিস্থিতি আগামীতে আরও খারাপ হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নগরবাসীর প্রয়োজনেই গাছ রক্ষা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে নগরীয় গাছ রক্ষা ও সবুজায়ন নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পবাজি ও উন্নয়নের নামে গাছ কাটা যাবে না। নগরের অস্তিত্বের সঙ্গে গাছ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নগরীর সবুজ এলাকার তাপমাত্রা ও বাণিজ্যিক এলাকার তাপমাত্রার অনেক পার্থক্য রয়েছে।  তিনি আরও বলেন, যেসব এলাকায় গাছ নেই, সেই সব এলাকার তাপমাত্রা একরকম, আর যেসব এলাকায় গাছ রয়েছে সেখানের তাপমাত্রা ভিন্ন রকম- যা অনেকটা সহনশীল। এই শহরে গাছ বা সবুজায়ন কমে যাওয়ায় নগরীতে বৃষ্টিপাত কমেছে। একই সঙ্গে খরা বেড়েছে। যা নগরবাসীর জন্য হুমকি স্বরূপ।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশন সবুজায়ন বাড়াতে গণ-বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও ক্রমবর্ধমান নগরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রভাবে নগরগুলোর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত হচ্ছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন করার জন্য নগরীর প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার একান্ত প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন আওতাধীন এলাকা সবুজায়নের লক্ষ্যে সড়কের ফুটপাত, সড়কদ্বীপ, পার্ক, খেলার মাঠ ও গণপরিসরে সবুজায়নের বিষয়ে নাগরিক মতামত চাওয়া হয়েছে। নাগরিকদের সুচিন্তিত মতামতের জন্য ডিএনসিসি ওয়েবসাইট http://www.dncc.gov.bd/forms/Street Planting এবং কিউআর ব্যবহার করে ডিএনসিসিকে এ বিষয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর