সোমবার, ১১ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক ডক্টর আবদুল কাদির খান

যেভাবে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেন পরমাণু বোমা

তানভীর আহমেদ

যেভাবে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেন পরমাণু বোমা

পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর আবদুল কাদির খান। [জন্ম : ১ এপ্রিল ১৯৩৬ - মৃত্যু : ১০ অক্টোবর ২০২১]

একনজরে

আবদুল কাদির খান ছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী এবং একজন ধাতুবিদ্যা প্রকৌশলী। পাকিস্তানের সমন্বিত পারমাণবিক বোমা প্রকল্পের জন্য এইচইইউ ভিত্তিক গ্যাস-সেন্ট্রিফিউজ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণ প্রোগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয় তাকে। ১৯৭৬ সালে তিনি খান গবেষণা পরীক্ষাগার (কেআরএল) প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে থাকতেন। ১৯৭৫ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর এ কিউ খান বিদেশ থেকে ফিরে এলে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি বিপুল গতি লাভ করে। তিনি সেন্ট্রিফিউজ ডিজাইন ও জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক চুক্তিগুলো করেন। ইউরোপীয় দেশগুলো এতে সহায়তা করে। বোমা তৈরির কাজ ১৯৭৮ সালেই শেষ হয় এবং ১৯৮৩ সালে এর ‘কোল্ড টেস্ট’ করা হয়।

 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে গোপন বৈঠক নেদারল্যান্ডস থেকে পরমাণু বোমা তৈরির কৌশল চুরি

আবদুল কাদির খানের হাত ধরেই পাকিস্তান হাতে পায় পরমাণু অস্ত্র। পরমাণু বোমা তৈরির কৌশল হাতিয়ে নেওয়া এ বিজ্ঞানীর জীবনী যে কোনো রোমহর্ষক সিনেমাকেও হার মানাবে। ১৯৯৭ সালের শেষ দিকে প্রথম বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসেন এ পরমাণু বিজ্ঞানী। ভারতের পরমাণু পরীক্ষার মাত্র দুই সপ্তাহ পরই পাকিস্তান ১৯৯৮ সালের ২৮ মে একসঙ্গে ৫টি ও পরে ৩০ মে আরও ১টি অর্থাৎ মোট ৬টি বিস্ফোরণ ঘটায় বেলুচিস্তানের চাগাই পর্বতে। তখনই জানা যায়, পাকিস্তানের এ পরমাণু বোমা বানানোর পেছনে রয়েছেন ড. আবদুল কাদির খান। তার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের ভূপালে। ১৯৫২ সালে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন। উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ পান জার্মানিতে। জার্মানির বার্লিন থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। মেটালার্জিতে মাস্টার্স করেন নেদারল্যান্ডস থেকে। পরে বেলজিয়াম থেকে ওই একই বিষয়ের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি পান তিনি। ১৯৬৪ সালে ইউরোপে পড়ার সময় নেদারল্যান্ডসের নাগরিক হেন্ডরিনা রিটারিংকে বিয়ে করেন। ১৯৭২ সালে স্ত্রী নেদারল্যান্ডসের নাগরিক হওয়ার সুবাদে নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের যৌথ পরিচালনায় আণবিক বোমা তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কারখানা ইউরেনকো এবং পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডের আলমেলোতে প্রবেশের সুযোগ পান তিনি। আলমেলো নেদারল্যান্ডসের বিভিন্ন পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির কারখানার জন্য সেন্ট্রিফিউজ সরবরাহ করত। আর এটাই দরকার ছিল আবদুল কাদির খানের। ডাচ ভাষায় দক্ষ হওয়ায় সেখানে তার মূল কাজ ছিল বোমা তৈরির যাবতীয় ডকুমেন্ট জার্মান ভাষা থেকে ডাচ ভাষায় অনুবাদ করা। ইউরেনকো তাকে সিনিয়র টেকনিক্যাল পদে চাকরির প্রস্তাব দিলেও তিনি সেটা ফিরিয়ে দেন। সে সময় জানান, তিনি ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে আরও গবেষণা করতে চান। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনি নিজ দেশে পরমাণু বোমা তৈরি আগ্রহ দেখান। ভুট্টো তিন মাসের ব্যবধানে তার সঙ্গে গোপন বৈঠকের জন্য ডেকে আনেন। পরিকল্পনা মতো স্ত্রী ও দুই কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচুর অমূল্য নকশা এবং সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ের তালিকা চুরি করে পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। বোমার সেন্ট্রিফিউজগুলো ইউরেনকো গ্রুপ থেকে চুরি করেন। তবে সেগুলোতে বড় ধরনের ত্রুটি ছিল ও কিছু যন্ত্রাংশ ছিল বিচ্ছিন্ন, অপ্রস্তুত। আপাত দৃষ্টিতে সেগুলো কোনো কাজের না হলেও আবদুল কাদির খান সেগুলো মেরামত করেন ও নকশা দেখে ত্রুটিগুলো সারিয়ে তোলেন। এ চুরির ঘটনায় সেসময় নেদারল্যান্ডস সরকার ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে বহু চেষ্টা করেও তাকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়। দেশে ফিরে পাকিস্তান সরকারের সহযোগিতায় খান রিসার্চ ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করে আণবিক বোমা বানানোর কাজে হাত দেন। ১৯৭৬ সালে তিনি আরেক পরমাণু বিজ্ঞানী খলিল কোরেশীর সঙ্গে পরমাণু বোমা তৈরির কাজে যোগ দেন।  ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির অধীনে হাতাফ, গৌরী, আবদালী, শাহীন প্রভৃতি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে পাকিস্তানে বীরের মর্যাদা লাভ করেন।  গতকাল ইসলামাবাদের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৮৫ বছর বয়সী এ বিজ্ঞানী।

 

স্ক্যান্ডালে জড়ালেন যেভাবে

২০০৪ সালে আবদুল কাদির খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন তখনকার সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। তার অভিযোগ, ড. আবদুল কাদির খান পারমাণবিক সামগ্রীর একটি দুর্বৃত্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। অর্থাৎ তিনি পারমাণবিক প্রযুক্তি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করছেন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এ ঘোষণার অল্প পরেই আবদুল কাদির খানের স্বীকারোক্তিমূলক একটি রেকর্ডেড বক্তব্য প্রচার করা হয়। এতে তিনি অভিযোগের দায় নিজের কাঁধে নেন। জানা যায়, তিনি পরমাণু বোমার মূল উপাদান ইউরেনিয়াম তৈরির জন্য ডিজাইন থেকে শুরু করে হার্ডওয়্যার এমনকি উপকরণ পর্যন্ত সবকিছু সরবরাহ করেছিলেন ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো বিভিন্ন দেশে।

 

জাতীয় বীর তবুও ছিলেন গৃহবন্দী

বিশ্বজুড়ে পরমাণু বোমা তৈরির কৌশল পাচারের কথা স্বীকার করে অফিশিয়াল পদমর্যাদা হারিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন আবদুল কাদির খান। পরে অবশ্য প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের ক্ষমা পেয়ে কারাগারে যাওয়া থেকে রক্ষা পান। তবে এরপর থেকে তার জীবনযাপনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়, গৃহবন্দী হন। ২০০৯ সাল থেকে গৃহবন্দী থেকে তার অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে তিনি উল্লেখ করেন ‘তার কাছে না আছে কোনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায়, না তাকে নিজের মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে। নিজের চিকিৎসা করানোও রীতিমতো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যায় করা হচ্ছে তার সঙ্গে।’ দীর্ঘ পাঁচ বছর নজরবন্দী অবস্থায় নিঃসঙ্গ জীবন কাটানোর পরে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে মুক্তি পান তিনি। তবে তিনি বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। ২০২০ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের বরাবর পাঠানো হাতে লেখা এক নোটে লিখেন- ‘আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে।  আমার চলাফেরার স্বাধীনতা নেই।’ ম্যাক কেলম্যান-এর ‘এ কিউ খান’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ডক্টর খান নয় বরং পরমাণু বোমার অস্ত্রপাচার দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই সময়ের পাকিস্তানের সামরিক প্রধান পারভেজ মোশাররফ এবং উচ্চপদস্থ বেশ কিছু সেনা।  কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলে ডক্টর খানকে বলির পাঁঠা বানিয়ে বলপূর্বক তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য আদায় করে নেওয়া হয়।’

সর্বশেষ খবর