চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলার পাহাড়ী ঝর্ণাগুলো মন ভোলানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। কিন্তু এই অপরূপ ঝর্ণা প্রায়ই কিশোর ও তরুণদের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এসব ঝর্ণায় প্রাণ গেছে অন্তত ২০ জনের। লক্ষ্য করার বিষয়, এদের বেশিরভাগই উঠতি বয়সের কিশোর-তরুণ। মৃত্যু হয়নি কোনো নারীরও। মূলত কিশোর-তরুণদের অসর্তকতা, গাইড-ইজারাদার ও বন বিভাগের নির্দেশনাকে পাত্তা না দেয়ার কারণে ঝর্ণায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, কিছু প্রকৃতি প্রেমীর কল্যাণে ২০১৬-১৭ সাল থেকে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, রূপসী, বাওয়াছড়া ও সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা ঝর্ণা পর্যটন স্থান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিও’র কারণে এসব ঝর্ণা এখন পর্যটকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধির সাথে সাথে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, গত ৫ বছরে এসব ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক। সর্বশেষ গত ৪ অক্টোবার মুসফিকুর রহমান আদনান (২১) ও মাহবুব রহমান মুত্তাকিম (২১) নামের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তাদের একজন পাহাড়ের উপরে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ছবি তুলতে গিয়ে পড়ে যান। অন্যজন তাকে বাঁচাতে গিয়ে পড়ে যান। এর কয়েকদিন আগে মাহবুব হাসান নামের আরেক ব্যাক্তির মৃত্যু হয়।
বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে থাকা এসব ঝর্ণার সৌন্দর্য্য রক্ষা, রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকেন বন বিভাগের নিয়োগকৃত ইজারাদাররা। সার্বিক বিষয় দেখভালো করে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ। জানতে চাইলে উত্তর বন বিভাগের বারৈয়াঢালা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আশরাফুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যারা মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই ১৫-২৫ বছরের মধ্যে। এই বয়সের ছেলেরা কিছুটা স্বাধীনচেতা, অনেক ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী। নানা রকম ঝুঁকি নিতে চায়। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে লাল কাপড় বেঁধে দিই। ব্যানারে ঝুঁকির কথা লিখে দিই। খৈয়াছড়া ঝর্ণায় হ্যান্ডমাইক দিয়ে সচেতন করা হয়। এরপরও নির্দেশনা মানেন না। একারণে এসব দুর্ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। এব্যাপারে পর্যটকদের সচেতনতা জরুরি। নির্দেশনা মানতে হবে, গাইড ছাড়া যাওয়া যাবে না।’
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নারীরা অনেকে শাড়ি পরেও ঝর্ণায় যান। অনেকে বাচ্চা কোলে নিয়েও যান। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একজন নারীর মৃত্যু হয়নি। কারণ নারী ও বয়স্ক পুরুষরা নির্দেশনা মেনে চলেন। একারণে তারা দুর্ঘটনার শিকার হননা। অন্যদিকে উঠতি বয়সী কিশোর তরুণদের মধ্যে এক ধরণের উন্মাদনা কাজ করে। তারা ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কূপে ডুব দেয়। পাহাড়ের উঁচুতে উঠে এমন ছবি তুলতে চায়, যেটা অন্যরা তুলতে ভয় পাবে। একারণে তারা বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন। অনেকে আবার বিভিন্ন মাককদ্রব্য সেবন করেও ঝর্ণায় গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন।
জানতে চাইলে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের কর্মকর্তা ইমাম হোসেন পাটোয়ারী বলেন, ‘বেশিরভাগ হতাহতের ঘটনাগুলো হচ্ছে পর্যটকদের অসতর্কতার কারণে। সৌন্দর্য দেখতে এসে এমন মৃত্যুর শিকার হওয়া খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। এতে অন্য পর্যটকদের মধ্যেও বিরূপ প্রভাব আসতে পারে। এব্যাপারে সবার সচেতন হওয়া দরকার।’
খৈয়াছড়া ঝর্ণায় গাইডের দায়িত্ব পালন করা মুমিনুল ইসলাম বলেন, ‘পর্যটকদের মধ্যে গাইড নিয়ে আগ্রহ কম। অনেকে গাইড নিতে চাইলেও ২-৩’শ টাকার বেশি দিতে চান না। একজন গাইড অর্ধেক অথবা পুরোদিন সময় দিয়ে দৈনিক মজুরিটা না পেলে সে কিভাবে চলবে। আবার অনেকে গাইড নিলেও গাইডের নির্দেশনাও পুরোপুরি মানেন না। নির্দেশনা মেনে চললে দুর্ঘটনা খুব কম হবে।’
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল