শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আত্মহত্যায় এগিয়ে নারীরা

জিন্নাতুন নূর

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার তপতী পোদ্দার (৩৫) নামে এক নারী চিকিৎসক গত বুধবার সকালে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই নারী চিকিৎসক বাগেরহাট সদর হাসপাতালের ম্যাটারনাল নিউনেটাল হেলথ প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। গত বছর তার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় পর থেকেই তিনি বিপর্যস্ত ছিলেন। এ জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও তপতী চিকিৎসা গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাপ সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেন। গত মাস শেষে চাঁদপুর সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের মধ্য বাগাদী গ্রামে সাথী আক্তার (১৪) নামের  অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। পরীক্ষার নির্ধারিত ফির পুরো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন সাথীকে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখেন। এতে অপমানিত হয়ে সাথী বাড়ি ফিরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। তপতী ও সাথীদের মতো বাংলাদেশে এমন আরও অনেক নারী, তরুণী-কিশোরী আছেন- যারা নিজেদের অপমানবোধ, মানসিক অসুস্থতা এবং নির্যাতন ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যা করছেন। এমনকি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশে আত্মহত্যার ঘটনাও এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর পুরুষদের তুলনায় বাংলাদেশে নারীদের আত্মহত্যা করার হার বেশি। বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত স্বামীর সঙ্গে কলহ, পরকীয়া, স্বামী দ্বারা অপমান, এমনকি কাঙ্ক্ষিত পোশাক বা পণ্য না পেয়েও নারী ও তরুণীরা অভিমানে আত্মহত্যা করছেন। অন্যদিকে নির্যাতিত গৃহবধূরা স্বামীর অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে অনেক সময় শেষ উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছেন। এ ছাড়া ডিভোর্সপ্রাপ্ত নারীরা অনিরাপত্তা থেকে এবং তরুণীরা অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর প্রতারিত হয়েও আত্মহত্যা করছেন। এ অবস্থায় আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময়ে আত্মহত্যার পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরুষদের চেয়ে বর্তমানে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করছেন। যেমন ২০১২ সালে আত্মহত্যা করেন মোট ২০৮ জন নারী, আর আত্মহত্যাকারী পুরুষের সংখ্যা ৯৭ জন। ২০১৩ সালে মোট ১৯২ জন নারী আত্মহত্যা করেন, আর পুরুষদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১০১ জন। ২০১৪ সালে নারীরা আত্মহত্যা করেন মোট ৩৬৭ জন, আর পুরুষদের সংখ্যা ১৯৮ জন। ২০১৫ সালে আত্মহত্যা করেন ২২৩ জন নারী, আর  সেখানে পুরুষের সংখ্যা ১২৬ জন। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে মোট ১৩৮ জন নারী আত্মহত্যা করেন, যেখানে পুরুষের সংখ্যা ৬১ জন।  বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর বিষ খেয়ে, ফাঁসিতে ঝুলে, ট্রেনে কাটা পড়ে, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। আর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী। উদ্বেগের বিষয় এই, যে নারী ও তরুণীরা আত্মহত্যা করেন তাদের থেকে যারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন- তাদের সংখ্যা আরও বেশি। বিশেষ করে দেশের বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীদের ২০ ভাগই আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন। আর গুরুতর আঘাত নিয়ে তাদের বাকি জীবন কষ্ট পোহাতে হয়। মনোবিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত অতিমাত্রায় বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা আত্মহত্যা করেন। তবে বিষণ্নতার কারণে এখন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে। সাধারণত আত্মহত্যার ধরন দুটি। একটি তাত্ক্ষণিক তাড়না থেকে আত্মহত্যা, অন্যটি পরিকল্পিত আত্মহত্যা। সাধারণত তরুণী ও কিশোরীদের মধ্যে অনেকেই ভালোবাসার সম্পর্কে প্রতারণার কষ্ট, ইন্টারনেটে নিজের অশ্লীল ছবি ছড়িয়ে পড়ার অপমান, বখাটেদের হাতে উত্ত্যক্ত হওয়া ও অভিভাবকের শাসনের জন্য অভিমান করে তাত্ক্ষণিক তাড়না থেকে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটান। মনোবিজ্ঞানী ড. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাদের সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে। আর পরিবারের লোকজনদের আত্মহত্যা প্রবণ রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। মোহিত কামালের মতে, পারিবারিক সংকটের বিষয়টি যে কোনো পরিবারের জন্য অত্যন্ত নিন্দনীয়, তবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া একমাত্র সমাধান নয়।

সর্বশেষ খবর