রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন শামসুজ্জামান আউয়াল। অপসারিত মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের এতটাই আস্থাভাজন ছিলেন, সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পদ, সবকিছুতে আউয়ালের কথা-ই ছিল শেষ কথা। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও শামসুজ্জামান আউয়াল রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের কোটায় হয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কাজ, জমি কেনাবেচা, পুকুর ভরাট করে বিক্রি, ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে সহযোগিতা করে এখন হাজার কোটি টাকার মালিক তিনি। ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো আত্মগোপনে আছেন শামসুজ্জামান আউয়াল।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ঠিকাদারির মাধ্যমে আবির্ভাব ঘটে শামসুজ্জামান আউয়ালের। অন্য ঠিকাদারদের কাজ কিনে নিয়ে পেশা শুরু করেন। ২০০৮ সালে খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র হলে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ঠিকাদারি কাজের একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন। নগর ভবনের পাশে দারুচিনি প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন নির্মাণ ও সোনাদীঘি এলাকায় বৈশাখী মার্কেটের কাজ নিজের নামে নেন আউয়াল। তবে দুটি মার্কেট ১৫ বছরেও নির্মাণ শেষ করেননি। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রেখেছেন নিজের কাছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক বিনিয়োগকারী জানান, বৈশাখী মার্কেটে দোকান পেতে আউয়ালকে টাকা দিয়েছেন। এখন দোকান পাচ্ছেন না, টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির মূলহোতা নাবিল গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের পাশাপাশি ঘনিষ্ঠতা আছে তার ব্যবসায়িক অংশীদার এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শামসুজ্জামান আউয়ালেরও। গত ৭ জুলাই ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে নাবিল গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা গেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং পর্যাপ্ত সম্পত্তি বন্ধক ছাড়াই নাবিল গ্রুপ রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, এর নেপথ্যে সহায়তা করেছেন খায়রুজ্জামান লিটন। ঋণের ওই অর্থের একটি অংশ লিটন-আউয়ালের পকেটেও গেছে।
রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর ভাটাপাড়ার নুরুল ইসলাম মারা যান ২০২১ সালে। সিটি করপোরেশন ও হাসপাতালের মৃত্যু সনদ অনুযায়ী সে তারিখ ২০২১ সালের ১ জুন। তার মৃত্যুর কারণ ব্রেন স্ট্রোক। মৃত্যুর ১৩ দিন আগে তার স্বাক্ষরে আরডিএর কাছে জমা পড়ে একটি আবেদন। তাতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটি পুকুর ভরাট হওয়ায় শ্রেণি পরিবর্তন করে বাড়ি নির্মাণের অনুমতি চাওয়া হয়। তার ছেলে আসাদুজ্জামান জানান, সে সময় অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী থাকায় এ আবেদন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাক্ষরও ভুয়া বলে দাবি তাদের।
নাবিল গ্রুপের সঙ্গে লিটন-আউয়াল জুটির ব্যবসায়িক সম্পর্ক প্রথম প্রকাশ পায় ২০২১ সালে। ওই বছর রাজশাহী মহানগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকায় অবস্থিত ১২৬ কাঠার পুকুর সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করে ভরাট করা হয়। ২০২২ সালে পুকুরটির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। সে সময় জানা যায়, লিটন-আউয়াল জুটি এই জমিতে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য নাবিল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
নগরীর মুশরইল এলাকায় শামসুল আরেফিন নামের অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তার জমি দখল করার চেষ্টা করেছিলেন শামসুজ্জামান আউয়াল। এ নিয়ে আদালতে মামলা করেন ওই ব্যক্তি। শামসুল আরেফিন জানান, তার জমিটি দখলে নিতে শামসুজ্জামান আউয়াল ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমন ক্যাডার বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
সে সময় শামসুজ্জামান আউয়াল দাবি করেছিলেন, তিনি জমি দখলের চেষ্টা করেননি। ওই জমিতে সিটি করপোরেশন কবরস্থান করবে বলে তিনি শুনেছেন। জমিটি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় আছে।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আরসিসিআই) সাবেক এক পরিচালক বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে নাবিল গ্রুপ পেছন থেকে আরসিসিআই নিয়ন্ত্রণ করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পরিচালক বলেন, ‘খায়রুজ্জামান লিটনের প্রভাবে শামসুজ্জামান আউয়াল স্বপনের স্ত্রী ইসরাত জাহানকেও নাবিল গ্রুপের পরিচালক দেখিয়ে আরসিসিআই পরিচালক করেন।’ রাজশাহী চেম্বারের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘শামসুজ্জামান আউয়াল ঠিকাদার হিসেবে চেম্বার অব কমার্স থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। তার আর কোনো ব্যবসা আছে কি না জানা নেই।’
দামি একাধিক গাড়ি আছে শামসুজ্জামান আউয়ালের। প্রভাব খাটিয়ে ভাইকে করেছিলেন সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ৫ আগস্টের পর থেকে শামসুজ্জামান আউয়ালকে বাইরে দেখা যায়নি। নগরীর দরগাপাড়ার বাড়িতে পরিবারসহ থাকছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। তবে তার নম্বরে (০১৭৬৭-৮২৮২৫৬) একাধিকবার কল করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।