শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

জাতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ আমাদের কম

প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর আশিতম জন্মবার্ষিকী আজ। একুশের প্রভাত ফেরির গান \'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো\'-এর রচয়িতা। মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কর্মী এই প্রবীণ সাংবাদিক সুদূর লন্ডনে বসেও মাতৃভূমি নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- শেখ মেহেদী হাসান

জাতির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ আমাদের কম

আপনার ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে আমাদের শুভেচ্ছা।

আপনাদেরও শুভেচ্ছা।

 

স্কুলজীবনেই আপনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময়ের সঙ্গে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির তফাৎ কি?

স্কুলজীবনে মার্কসবাদী সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে আমার সাম্যবাদী-প্রগতিশীল রাজনীতিতে হাতেখড়ি। যোগ দিয়েছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের মিছিলে। তারপর প্রয়াত রাজনীতিবিদ-অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বসুর আহ্বানে পটুয়াখালীতে কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সম্মেলনে যোগ দিতে যাই। সেখানে গিয়ে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এ ছাড়া বরিশালের বামপন্থি রাজনৈতিক দল আরএসপির সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। এখনকার ছাত্র রাজনীতি হচ্ছে ব্যবসাভিত্তিক। আমরা পয়সার জন্য ছাত্র রাজনীতি করিনি। প্রথমে আমি ছাত্রলীগ করিনি। তখন ছাত্রলীগ ছিল সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। নাম ছিল মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে ছাত্রলীগ যখন অসাম্প্রদায়িক হয় তখন ছাত্রলীগে যোগদান করি। তখন ছাত্রলীগ করলে পয়সা পাব কিংবা মন্ত্রীদের সাহায্য পাব, লাইসেন্স পাব এগুলো ছিল না। বঙ্গবন্ধু তখন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি হয়তো পাঁচ টাকা দিয়ে বললেন, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রলীগের একটা শাখা গঠন করতে হবে, চলে যাও। তিনি কেবল যাওয়ার ট্রেন ভাড়া দিতেন। আমি কুমিল্লা গিয়ে হয়তো এক স্থানীয় নেতার বাড়িতে থাকতাম। খাওয়া-দাওয়া করতাম। মিটিং শেষ করে চলে আসতাম। স্থানীয় নেতা আমার ঢাকায় আসার ভাড়া দিয়ে দিতেন। এখন তো শুনি, ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের কোনো নেতাকে কোথাও পাঠালে আগেই যাওয়া-আসার টাকা নিয়ে নেন। যেটা সবচেয়ে খারাপ সেটা হলো ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতির নামে লাইসেন্স নিচ্ছে, হল দখল, মারামারি করে। প্রকাশ্যে করে এবং কোনো লজ্জাবোধ করে না। এখন ছাত্র রাজনীতি বলতে একটা দুর্বৃত্তপনা, সন্ত্রাস। এটা আমাদের সময়ে ছিল না। বরং ছাত্ররাই পথ দেখাত। আমাদের সময় ছাত্র রাজনীতি ছিল ছাত্রদের স্বার্থকেন্দ্রিক। আমরা দেশের জন্য ছাত্র রাজনীতি করতাম। করতাম দশের জন্য। আমাদের মধ্যে ভিন্ন মত থাকলেও দারুণ সহনশীল অবস্থা ছিল। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল। এখন ছাত্র রাজনীতি থেকে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না।

 

আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন তো ছাত্র আন্দোলনেরই ফসল।

আমাদের ভাষা আন্দোলন, হরফ রক্ষার আন্দোলন, রবীন্দ্রসংগীত রক্ষার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ সমস্ত আন্দোলনে ছাত্ররা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এখন তাদের ডাকতে হয়, তারা আসে এবং গুণ্ডামি বেশি করে। ছাত্র রাজনীতি এখন খুবই হতাশাজনক। ভাষা আন্দোলনের নেতা যাদের বলা হয় গাজীউল হক, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমান শেলী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কে জি মোস্তাফা, এম আর আক্তার মুকুল এরা সবই তখন ছাত্র ছিল।

 

ভাষা আন্দোলনের সময় আপনার 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি রচনার প্রেক্ষাপট জানতে চাই।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্ব যখন শুরু হয় আমি তখন বরিশাল এ. কে. হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। সে আন্দোলনে যোগ দিয়ে বরিশালে জেল খেটেছিলাম। ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব তখন আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছিলাম। গুলি হওয়ার পরে আমরা ঢাকা মেডিকেলে ছাত্রদের দেখতে যাই। গিয়ে দেখি ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে একটি লাশ পড়ে আছে। তার মাথার খুলিটি উড়ে গেছে। সেটা ছিল রফিকের লাশ। আমরা যে বরকত, রফিক, সালাম, জব্বারের কথা বলি। এই রফিক ছিল সেই রফিক। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ও পরে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম শহীদ রফিকের ছবি তুলছেন। ওই দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছিল আমারই ভাই নিহত হয়েছেন। রক্তমাখা লাশ দেখে এই গানের প্রথম দুটি লাইন আমার মনে জেগে ওঠে। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'। পুরো গানটি অবশ্য লিখেছি দু-একদিন পরে, ধীরে ধীরে লিখি। আহমদ হোসেন নামে আমার এক বন্ধু ছিল। ওর একটা সাইকেল ছিল যেটা আমাকে দিয়েছিল। সেটা নিয়ে আমি ঢাকা শহরে ঘুরতাম। আমি ক্যাম্পাস থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাইকেলে যাতায়াত করতাম। আমি তখন আরমানিটোলার বান্ধব কুটিরে থাকতাম। সেখানে গিয়ে দেখি সরকার নোটিস দিয়েছে বান্ধব কুটিরে ছাত্ররা থাকতে পারবে না। তারপর শফিক রেহমানের বেগমবাজারের নূরপুর ভিলায় উঠলাম। সেখানে গিয়ে কবিতাটি আরও কয়েক প্যারা লিখি। আবার বাসা পাল্টে বংশালে আমার বন্ধু দাউদ খান মজলিসের বাসায় উঠি। তখন আহমদ হোসেন এসে বলল, আমরা গেণ্ডারিয়াতে একটি গোপন সভা করছি। ওখান থেকে একটি লিফলেট বের হবে। কবিতাটা দ্রুত শেষ করে দাও। কবিতাটি ভাষা আন্দোলনের যে প্রথম লিফলেট বের হয় সেখানে 'একুশের গান' শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত 'একুশে সংকলনে' প্রকাশিত হয়।

 

প্রভাত ফেরির এ গানটিতে প্রথম সুর দিয়েছিল শিল্পী আবদুল লতিফ।

ভাষা আন্দোলনে আমাদের যে লিফলেট বের হয় সেটা লতিফ ভাইয়ের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। এটি পৌঁছে দিয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী আতিকুল ইসলাম। এই আতিক মশারির আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। তো আবদুল লতিফ ভাই গানটির প্রথম সুর দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করলেন। তখন আমার সামনে আইএ পরীক্ষা। এর আগেই আফতাফ মাহমুদ এলো। তার বাড়িও বরিশালে। তিনি বললেন, তোর এ গানটিকে নতুন সুর দেব। তিনি সুর দিলেন। পরে তার সুরটিই সর্বাধিক জনপ্রিয় হলো। ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদের সুরে প্রভাত ফেরির গান হলো। কিন্তু গান লেখা ও গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজ থেকে আমাদের ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এ গান শুনে জহির রায়হানের মাথায় আসল এ গানটি তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করবে। ১৯৬৯ সালে তিনি তার 'জীবন থেকে নেওয়া' চলচ্চিত্রে এ গানটি ব্যবহার করলেন। ফলে আরও জনপ্রিয় হলো।

গানটি সম্পূর্ণ গেয়েছে শিমুল ইউসুফ। এখন এটি ইংরেজি, ফ্রেন্স, জাপানি, সুইডিশসহ পাঁচটি ভাষায় গাওয়া হয়।

 

বর্তমানে বাংলা ভাষার যে যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে সেটিকে কীভাবে দেখেন?

আমাকে অনেকেই ভাষা সংগ্রামী বলে। এ শব্দটি আমি পছন্দ করি না। ভাষা সংগ্রামী ছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার- আমাদের লতিফ ভাই, গাজীউল হক প্রমুখ। তারা আমাদের নেতা ছিলেন। তারা যা আদেশ দিতেন আমরা তা পালন করতাম। আর ভাষার ব্যবহার যদি বলেন- পৃথিবীর সব ভাষা ক্রমাগত পরিবর্তন হয়। সেখানে নতুন নতুন শব্দ যোগ হয়। আমাদের সমস্যা বাংলা ভাষার প্রমিত ব্যবহারের প্রতি কারও নজর নেই। বাংলা ভাষায় গ্রহণী শক্তি বেশি। আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা থেকে আমরা প্রচুর শব্দ আহরণ করেছি। এখনো সেই আহরণ পর্ব চলছে। অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করবে নতুন প্রযুক্তির যেসব শব্দ রয়েছে, তা বাংলা ভাষা খুব দ্রুত আহরণ করেছে। এ ব্যাপারে একটা বিপদও আছে। দ্রুত আহরণ করলে অনেক সময় অবাঞ্ছিত শব্দও ঢুকে পড়ে ভাষায়।

বাংলা ভাষায়ও তাই হয়েছে। শিশুরা টেলিভিশন দেখে চমৎকার হিন্দি বলতে পারে। অন্যদিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো বাচ্চাদের রোবটে পরিণত করছে। তবে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, সরকারিভাবে বাংলা ভাষা এখনো ঠিকমতো প্রয়োগ হচ্ছে না। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষায় কাজ-কর্ম সম্পাদন হচ্ছে। এমনকি আমাদের বিচার বিভাগেও বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না।

 

ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে আপনাদের বিশাল আড্ডা হতো। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে!

বিউটি বোর্ডিংয়ের আগে এর অসাধারণ একটি ইতিহাস আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন 'সোনার বাংলা'। সাপ্তাহিক এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নলিনী কিশোর গুহ। ওই সময় পত্রিকাটি দারুণ জনপ্রিয় ছিল। বর্তমান বিউটি বোর্ডিংয়ের জায়গায় ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস ও প্রেস। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর পত্রিকাটি বিক্রি হয়ে যায়। তারপর সেখানে বিউটি বোর্ডিং হয়। ১৯৪৯ সালে কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা 'সোনার বাংলা'য় ছাপা হয়। আমি থাকতাম কলতাবাজার আবদুর রউফ রোডে। আমার ভাই আসাদ চৌধুরীর বাবা আরিফ চৌধুরী ছিলেন মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি। তার সঙ্গে প্রথম বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়েছিলাম। কলতাবাজার থেকে হেঁটে যেতাম শিরিষ দাশ লেনের ওই বাড়িটায়, সেখানে আমাদের আড্ডা হতো। বিউটি বোডিংয়ের মালিক আমাদের সবাইকে জড়ো করেছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, কাইয়ূম চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, কায়সুল হক, মুর্তজা বশীর, দেবদাশ চক্রবর্তী প্রমুখ। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন মধ্যমণি। পঞ্চাশের দশকের যত লেখক-সাহিত্যিক ছিলাম সব আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিতাম। বিনা পয়সার চা সিঙ্গারা খেতাম। প্রতিদিন রাত ১০টা/১১টা পর্যন্ত আড্ডা হতো। তখন একদিকে ছিল সওগাতের আড্ডা অন্যদিকে ছিল বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা। দুটোই ছিল তরুণ সাহিত্যিকদের গড়ে ওঠার কেন্দ্র। আমরা বেনামে 'বেগম' পত্রিকায়ও লিখতাম।

 

কৈশোরে তো আপনি কবিতা লিখতেন?

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে আমার কবিতা লেখার শুরু, তারপর গল্প। স্কুলজীবনে ১৯৪৯ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত কলকাতার মাসিক 'সওগাত' পত্রিকায় 'স্বাক্ষর' নামে আমার গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পটির বিষয়বস্তু ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন গ্রামবাংলার পটভূমি। 'শিশু সওগাত'-এ প্রকাশিত হয় আমার প্রবন্ধ 'যুগধর্ম'। সাহিত্যিক বিমল ঘোষ ওরফে মৌমাছির নেতৃত্বে অবিভক্ত বাংলায় গড়ে ওঠা কলকাতার 'আনন্দবাজার' পত্রিকার শিশু সংগঠন 'মণিমেলা'র সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। মণিমেলার আদলে মোহাম্মদ মোদাব্বের ওরফে বাগবানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঢাকার 'আজাদ' পত্রিকার 'মুকুলের মহফিল'-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। এরপর কলকাতার 'নবযুগ' পত্রিকায় আগুনের ফুলকি বিভাগে 'পান্থশালা' নামে নাটিকা ছাপা হয়। আমাদের বরিশালের গির্জা মহল্লার হামিদিয়া প্রেস থেকে প্রকাশিত নূর আহমদ সম্পাদিত প্রগতিশীল পত্রিকা 'সাপ্তাহিক নকীব'-এ আমার লেখা ছাপা হতো। পড়াশোনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প লিখে আমি আনন্দ পেতাম।

 

আপনার 'কৃষ্ণপক্ষ', 'সম্রাটের ছবি', 'সুন্দর হে সুন্দর'-এর মতো গল্পগ্রন্থ; কিংবা 'চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান', 'তিমির-সঙ্গিনী', 'নীল যমুনা', 'শেষ রজনীর চাঁদ' নামে অসাধারণ কিছু উপন্যাস রয়েছে। গল্প, উপন্যাস থেকে আপনার পাঠকদের বঞ্চিত করলেন কেন?

বাঁচার তাগিদে। তখন একটা গল্প লিখলে একশ টাকা দিত। সেটা আদায় করতে আবার একশ টাকার রিকশা ভাড়া লাগত। তারপরও লিখতাম। কিন্তু বিয়ে করার পর দেখলাম কবিতা আর গল্প লিখে সংসার চলবে না। এরপর সাংবাদিকতায় চলে আসি। সাংবাদিকতায় টাকা ছিল। বেতন তো আছেই, রাজনৈতিক কলাম লিখেও টাকা পেতাম। আমি এখনো পাঁচটি কাগজে লিখলে যে টাকা পাই একটি উপন্যাস লিখলে তো সে টাকা পাব না।

 

মুক্তিযুদ্ধেও আপনার ভূমিকা ছিল।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলাম। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত কথিকা-লেখক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও কাজ করেছিলাম।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখন?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি প্রথম দেখেছিলাম চলি্লশের দশকে ঢাকার তাঁতিবাজারে আমার নিকটাত্দীয় বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরীর বাসায়। ১৯৫৪-এর দিকে 'সওগাত' পত্রিকায় কর্মরত অবস্থায় যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছ থেকে দেখি। 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত একটি কুৎসামূলক সম্পাদকীয়-বক্তব্য খণ্ডন করে আমি 'মিল্লাত'-এ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে এর জবাব লিখেছিলাম। এই সম্পাদকীয়টি শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরে 'ইত্তেফাক' ভবনে আমাকে ডেকে নিয়ে শেখ মুজিব পার্কার কলম উপহার দিয়ে অভিনন্দিত করেছিলেন। এ ছাড়া ষাটের দশকে আমার 'দশ দিগন্ত' কলামও বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৬৭-তে 'আজাদ' পত্রিকায় 'তৃতীয় মত' কলামে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয়দফা দাবির সমর্থনে কলাম লিখেছিলাম যা তিনি জেলখানায় বসে পড়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ (ন্যাম) সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম।

 

আপনি অনেক মহান নেতা, লেখক, শিল্পীর সান্নিধ্য পেয়েছেন। বিশেষভাবে কারও কথা মনে পড়ে?

অনেকের কথা মনে পড়ে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ মুজতবা আলী, শওকত ওসমান, কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি আবদুল কাদির, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদসহ অনেকেই।

 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনি তো একটি নাটক লিখেছিলেন।

সিরাজউদ্দৌলা লিখেছিলেন শচীন সেনগুপ্ত। তার নাটকটি আজও গ্রামবাংলায় মঞ্চস্থ হয়। মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এ নাটক। আমি তো তার মতো মেধাবী নই; তবু চেষ্টা করেছি বঙ্গবন্ধুর জীবনীমূলক এ নাটকটি লিখতে। নাটকটি ব্রিটেন, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। এতে সৈয়দ হাসান ইমাম, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয় করেছেন।

 

আমাদের দেশে নারীর কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতায়ন কতখানি হয়েছে বলে মনে করেন?

এটা সত্যি যে, আমাদের দেশের সরকারপ্রধান ও বিরোধীদলীয় প্রধান দুই জনই নারী। তারপরও বাংলাদেশের নারীর কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতায়ন আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আবার এটাও ঠিক, অনেকাংশে নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক দূর যেতে হবে। শ্রদ্ধেয় নবাব ফয়জুন্নেসা, বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে আজকের মালেকা বেগম, আয়েশা খানম সবাই এ নিয়ে লড়ছেন। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার কিছুটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্পে বহু গ্রামীণ নারী কাজ করছেন। অফিস-আদালতেও অনেক নারী বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। তবুও পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আজও পুরুষ পক্ষপাত থাকে।

 

আপনারা যে কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা কতখানি পূরণ হয়েছে?

আমাদের দেশপ্রেমের অভাব রয়েছে। যেমাত্র বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে তখনই আমরা বাংলা ভাষাকে ত্যাগ করেছি। ওটা ছিল আমাদের ক্ষমতা দখলের অস্ত্র। আবার যে মুহূর্তে আমরা স্বাধীনতা পেয়ে গেছি তখনই আমরা পাকিস্তানি হয়ে গেছি। পাকিস্তান আমলেও যে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ ছিল তা অনেকাংশে বিনষ্ট হয়েছে। হেফাজত, জামায়াতের যে প্রতাপ বেড়েছে তা ভাবা যায় না। গোটা পাকিস্তান আমলে ওদের শাসন-শোষণ ছাড়া বাংলা ভাষাকে তারা গুরুত্ব দিত। তখন বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ ছিল। জাতির উন্নয়নে কিছু নৈতিক মূল্যবোধ লাগে, যা আমাদের কমই আছে। সুতরাং আমি দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী কিন্তু এ মুহূর্তে খুব আশাবাদী নই।

 

 

সর্বশেষ খবর