সহজেই বেশি কিছু পাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কোনো পরিশ্রম না করে, কোনো কাজ না করে যদি অল্পদিনের ব্যবধানে টাকা দ্বিগুণ করা যায়, তবে কে না আগ্রহী হবে! সাধারণ মানুষের এই আগ্রহকে পুঁজি করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করে চলেছে একটি চক্র। বিভিন্ন হায় হায় কোম্পানি অতীতে মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এবার নতুন মোড়কে এসেছে পুরনো প্রতারকচক্র, যারা ‘ডিল ফেয়ার’ নামে কার্যক্রম চালাচ্ছিল সিলেটে।
গত প্রায় ছয় মাস ধরে সিলেটে চলছিল ‘ডিল ফেয়ার’ নাম হায় হায় কোম্পানির প্রতারণা। এই সময়ে এর সাথে জড়িত চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। অবশেষে এই প্রতারকচক্রের সাথে জড়িত ‘ডিল ফেয়ার’র এক কর্মকর্তা ধরা পড়েছেন র্যাবের হাতে। তবে প্রতারকচক্রের মূলহোতা আব্দুল গণি খান রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে, গত ছয় মাস আগে ‘আমার বাজার ডটকম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারস্থ ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটির ৭ম তলায় অফিস কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠান অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আব্দুল গণি খান এই অফিস ভাড়া নেন। ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটি কর্তৃপক্ষও এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সামনে ‘আমার বাজার ডটকম’ নামক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড থাকলেও ভেতরে চলছিল অন্য কারবার। ‘ডিল ফেয়ার’ নামক একটি ভুঁইফোড় কোম্পানি প্রতারণার ফাঁদ নিয়ে বসেছিল সেখানে। যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে মাত্র ২শ’ দিনে টাকা দ্বিগুণ করার লোভ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন আব্দুল গণি খান গংরা। এই চক্রে ছিলেন জৈন্তাপুরের তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের হেলাল আহমদ সবুজও, যিনি র্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন সোমবার রাতে।
জানা গেছে, আব্দুল গণি খান ও হেলাল আহমদ সবুজ উভয়েই একসময় একটি সমালোচিত এমএলএম প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আব্দুল গণি খানের বাড়ি সিলেটের বাইরে। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে সিলেটে এসে দক্ষিণ সুরমায় লজিং থাকতেন। মদন মোহন কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন তিনি। ওই সময় বাইসাইকেলযোগে কলেজে যাতায়াত করতেন গণি। ২০০০সালে সিলেটে উপশহরস্থ জয়-জুলি বাসায় ওই এমএলএম এর কার্যালয়ে হিসাব রক্ষক হিসেবে চাকরি শুরু করেন আব্দুল গণি খান। বেশি লাভের আশায় কিছুদিন পর ওই এমএলএম প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিংয়ে জড়িত হন তিনি। ওই সময় ওই এমএলএম প্রতিষ্ঠানের কথিত পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন গণি। রাতারাতি পাল্টে যায় তার হাবভাব। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়তে শুরু করেন তিনি।
সূত্র জানায়, ওই এমএলএম প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয়টি বেরিয়ে এলে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নতুন ‘ধান্দা’র সন্ধানে ঘুরতে থাকেন আব্দুল গণি খান। সম্প্রতি তিনি ‘ডিল ফেয়ার’ নামক ভুঁইফোড় কোম্পানি নিয়ে প্রকাশ্যে আসেন। এজন্য নগরীর জিন্দাবাজারস্থ ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটির ৭ম তলায় ‘আমার বাজার ডটকম’ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য অফিস কক্ষ নেন গণি। মূূলত ‘ডিয় ফেয়ার’র প্রতারণার বিষয়টি আড়াল করতেই ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ভাড়া নেওয়া হয় অফিস। ‘ডিল ফেয়ার’ নামক প্রতিষ্ঠান মাত্র ২শ’ দিনে টাকা দ্বিগুণ করার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ‘ডিল ফেয়ার’ নামক কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি নেই। তবে আমেরিকার হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে ‘ডিল ফেয়ার হাওয়াই’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সিলেটে আব্দুল গণি খানচক্র ‘ডিল ফেয়ার’কে আমেরিকার কোম্পানি হিসেবেই চালিয়ে দিচ্ছিল। বিনিয়োগকারীদের টাকায় আমেরিকায় ব্যবসা করে কোম্পানি দ্বিগুণ লাভ দেবে, এমনই লোভ দেখানো হতো বিনিয়োগকারীদের।
সিলেট অঞ্চলে ‘ডিল ফেয়ার’ জন্য কয়েকজন এজেন্টও নিয়োগ করা হয়। এই হায় হায় কোম্পানির হয়ে কাজ করেন সিলেটের সবুর, শাহপরানের সানওয়ার, মোগলাবাজারের হাসান, রাসেল, ওসমানীনগরের স্বপন, শ্রীমঙ্গলের ফারুক হোসেন সুজন, হবিগঞ্জের দুলালসহ বেশ কয়েকজন।
তথ্যানুসারে, ‘ডিল ফেয়ারে’ বিনিয়োগের হিসাব হয় মার্কিন ডলারে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মার্কিন ডলারের রেটে বাংলাদেশি টাকা নেওয়া হয়। প্রতি মার্কিন ডলারের জন্য ৯২ টাকা করে নেওয়া হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে প্রতি ডলারের মূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৮০-৮৬ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে। ‘ডিল ফেয়ারে’ এক হাজার মার্কিন ডলার (৯২ হাজার টাকা) বিনিয়োগ করলে মাত্র ২শ’ দিন পর দুই হাজার মার্কিন ডলার (এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা) দেওয়ার লোভ দেখানো হয়। অল্প সময়ে এই অতি লাভের আশাতেই এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, গেল ছয় মাসে দুই শতাধিক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে ‘ডিল ফেয়ার’। শুধু চলতি মাসেই অর্ধশত মানুষের কাছ থেকে প্রায় এক লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৯২ লাখ টাকা) হাতিয়ে নিয়েছে তারা। সবমিলিয়ে হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ অন্তত ৫-৬ কোটি টাকা হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, গেল সপ্তাহে সিলেটের জিন্দাবাজারস্থ হোটেল রাজমহলের একটি কক্ষে ওঠেন আব্দুল গণি খান। সেখানে নিজেকে কোম্পানির ‘বড় কর্তা’ পরিচয় দিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহী বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেন তিনি। তাদেরকে দ্বিগুণ লাভের লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহ দেন গণি। ওই সময় হেলাল আহমদ সবুজকে ‘সিলেটে কোম্পানির প্রধান’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন গণি।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত কিছুদিন ধরে ‘ডিল ফেয়ার’র কার্যক্রমে চোখ রাখছিল র্যাব। প্রতারণার বিষয়টি দৃশ্যমান হওয়ার পর সোমবার (২৬ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে ব্লু-ওয়াটারস্থ ‘আমার বাজার ডটকম’ নামক প্রতিষ্ঠানে র্যাব অভিযান চালায়। এ প্রতিষ্ঠানের আড়ালেই চলছিল ‘ডিল ফেয়ার’র কার্যক্রম। অভিযানে হেলাল আহমদ সবুজকে আটক করে র্যাব।
হেলাল গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের লামা মশখেড় গ্রামের মর্তুজ আলীর ছেলে।
র্যাবের অভিযানে প্রথমে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের কেউ নয়, বরঞ্চ বিনিয়োগকারী বলে পরিচয় দেন হেলাল। কিন্তু ওই সময় জকিগঞ্জ থেকে জুনেদ আহমদ নামের এক বিনিয়োগকারী টাকা দিতে হেলালের কাছে আসেন। তখন হেলালও প্রতারণায় জড়িত বলে বুঝতে পারে র্যাব। তাকে আটক করার পরও ‘বস’ হিসেবে আব্দুল গণি খানের পরিচয় দেন হেলাল। এই হেলাল টাকার বিনিময়ে ডেসটিনির হয়ে বিভিন্ন সেমিনারে ‘উদ্বুদ্ধকরণ’ বক্তব্য রাখতেন।
সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে আব্দুল গণি খানের মোবাইল ফোনের নাম্বারে কল দেওয়া হলে প্রথমে তিনি রিসিভ করেননি। পরে দফায় দফায় চেষ্টা করেও ওই নাম্বারে কল যায়নি।
র্যাব-৯ এর এএসপি ওবাইন জানিয়েছেন, ছয় মাসে টাকা দ্বিগুণ করার লোভ দেখিয়ে 'ডিল ফেয়ার' গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করছিল। তাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না। কয়েকজন গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালিয়ে একজনকে আটক করে।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন