কাপ্তাই হ্রদ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার। যা বাংলাদেশে এক মাত্র মিঠা পানির মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় অবস্থিত। এ হ্রদকে মৎস্য প্রজাতির বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশালী জলভাণ্ডার বলা হয়।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ১৯৬৪ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে ২ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির ডলফিন, ২ প্রজাতির কচ্ছপসহ ৭৬ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ ছিল। তার মধ্যে ৬৮ প্রজাতির দেশীয় ও ৮ প্রজাতির বিদেশী মাছ ছিল। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হতো। কিন্তু ড্রেজিংয়ের অভাব, গভীরতা হ্রাস, পানি ও পরিবেশ দূষণের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এ হ্রদের বহু প্রজাতির মাছ। ক্রমাগতভাবে তা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ৪২টি প্রজাতিতে। এতো কিছুর পরও এখনো ৩৫ প্রজাতির মাছ রাঙামাটি হ্রদ থেকে বাণিজ্যিকভাবে আহরিত হচ্ছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বাণিজিকভাবে বিক্রি হচ্ছে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। কাপ্তাই হ্রদে থেকে বর্তমানে আহরণ করা হচ্ছে রুই, কাতল, কালি বাউশ, কাচকি, চাপিলা, আইড়, বোয়াল, গজার, শৈল, মাগুর, শিং, কই, তেলাপিয়া, বাঁচা, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প, কার্পিও, রাজপুঁটি, তেলে নাইলোটিকা, তেলে মোজাম্বিকা, থাই মহাশোল, আফ্রিকা মাগুর, থাই পাংগাস, চিতল, সীল, দেশী সরপুঁটি, বাটা, কাকিলা, দেশী পাঙ্গাস, মৃগেল, টাকি, বাশঁপাতা, বাইম, ফলি, টেংরা, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, কাজরী, ঘনিয়া, কাঁটা মাইল্যা, ইল্যা, টিংড়ী, পুঁটি।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) বলছে, চলতি বছর রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ থেকে মাছ আহরণ করা হয় প্রায় ৫১৬০.৬৮মেট্রিক টন। আর রাজস্ব আদায় হয় প্রায় ৭ কোটি ৫ লাখ । যা গেল বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এভাবে মাছ উৎপাদন অব্যাহত থাকলে এ বছর রাজস্ব আয় অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করবে। এ মাছের সাথে জীবন ও জীবিকা জড়িত এ অঞ্চলের ২২ হাজার মৎস্যজীবীর। আর হ্রদে মাছের সুষ্ঠু প্রজনন ও উৎপাদন লক্ষ্যে প্রতিবছর ১ মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বন্ধকালীন সময় রাঙামাটি মৎস্য উন্নয়ন অধিদপ্তরের উদ্যোগে এ হ্রদে ছাড়া হয় বিপুল পরিমাণ পোনা মাছ। এসব পোনা বড় হওয়ার পর আবারও শুরু হয় মাছ শিকার।
রাঙামাটি জেলা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আজহার আলী জানান, রাঙামাটি দীর্ঘ বছর ধরে হ্রদের ড্রেজিং না হওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতি প্রজনন ক্ষেত্র ছিল-কাসালং চ্যানেলে মাইনীমুখ, বরকল চ্যানেলের জগন্নাথছড়ি, চেঙ্গী চ্যানেলের নানিয়ারচর ও রীংকং চ্যানেলের বিলাইছড়ি। এ চারটি নদীর চ্যানেলে মাছে সুষ্ঠু প্রজনন হতো। কিন্তু বর্তমানে কাসালং চ্যানেলে মাইনীমুখ ও রীংকং চ্যানেলে পলি জমাটের কারণে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২টি চ্যানেলে স্বাভাবিক থাকলেও কাপ্তাই হ্রদের দ্রুত ড্রেজিং করা না হলেও তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
রাঙামাটিতে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফডিসি) হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদের সম্পদের ভাণ্ডার বিশাল এবং আকর্ষণীয়। কিন্তু সঠিক ব্যবহারের অভাবে এই হ্রদের সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করা যাচ্ছে না। তবে বিএফডিসি রাঙামাটির মারিশ্যার চরে একটি বিলা হ্যাচারি স্থাপন করেছ। এ হ্যাচারিতে মাছের প্রাকৃতিগতভাবে প্রজনন ঘটিয়ে পোনা মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। বিশেষ করে কার্প জাতীয় মাছের পোনা। অনেক মৎস্য চাষী এ হ্যাচারি থেকে পোনা মাছ সংগ্রহ করে মাছ চাষ শুরু করেছে। অনেকে লাভবানও হয়েছে। তাছাড়া এ হ্যাচারীর উৎপাদিত পোনা মাছ সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে কাপ্তাই হ্রদের মাছের ঘাটতিপূর্ণ করা সম্ভব হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধের কারণে সৃষ্ট দেশের এই বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদটিকে মৎস্য সম্পদের ভাণ্ডারে পরিণত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারপর ১৯৬৪ সাল থেকে হ্রদ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য আহরণ শুরু হয়। এছাড়া ঋতু ও মৌসুমে ৯ ইঞ্চি সাইজের পর্যন্ত পোনা মাছ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা