আল্ট্রাসনোগ্রাম (চেকআপ) করতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন গর্ভবতী গৃহবধু সাবিনা আক্তার (৪০)। এসময় তার সঙ্গে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন দুই শিশু কন্যা ও ভাতিজিকে।
এদিকে স্ত্রী হাসপাতালে এসেছে এমন খবর পেয়ে স্বামীও ছুটে যান হাসপাতালে। আল্ট্রাসনোগ্রাম কক্ষে গৃহবধু সাবিনাকে রেখেই হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসকরা সাবিনার স্বজনদের বলেন, রোগীর অবস্থা ভালো না, জরুরিভাবে সিজার অপারেশন করাতে হবে। আপনারা টাকা-পয়সা নিয়ে আসুন।
চিকিৎসকের এমন সিদ্ধান্তে সাবিনার স্বামী স্বজনদের সাথে পরামর্শ করতে বাড়ি যান। কিন্তু হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসকদের আর তর সইল না। কখন অপারেশন করবেন। যেই সাবিনার স্বামী বাড়ি গেলেন, সেই ফাঁকে এক প্রকার জোর করেই সাবিনাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে অপারেশন শুরু করে দেন। অথচ সাবিনার স্বামী বা স্বজনদের কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করলেন না। এর কিছুক্ষণ পরেই অপারেশন থিয়েটার হতে বের করে নিথর দেহ (মৃত অবস্থায়) গাড়িতে তুলে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
আর এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমী বাজারের একটি বেসরকারি হাসপাতালে।
এ ঘটনার পরেই হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যায় চিকিৎসক ও হাসপাতালের মালিক পক্ষ। ওই হাসপাতালের নাম ইনসাফ ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক এন্ড হাসপাতাল। নামের মধ্যে ইনসাফ থাকলেও চিকিৎসায় নেই বিন্দুমাত্র ইনসাফ।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়।
পরে সোমবার সকালে শ্রীপুর থানা পুলিশ গৃহবধুর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ ঘটনার পর থেকেই হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে চিকিৎসকসহ মালিকপক্ষ পালিয়ে যায়। ইতোপূর্বেও এ হাসপাতালে চিকিৎসকদের ভুলে একাধিক মৃত্যুর ঘটনার বিচার দাবিতে উপজেলা প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েছেন এলাকাবাসী। এমনকি রোগীর মৃতদেহ নিয়ে উপজেলা চত্বরে মিছিলের ঘটনাও ঘটে।
নিহত গৃহবধু বরমী ইউনিয়নের সোহাদিয়া গ্রামের আব্দুস সাহিদের স্ত্রী। তার স্বামী আব্দুস সাহিদ বরমী বাজারের পুস্তক ব্যবসায়ী।
অভিযুক্ত চিকিৎসক মুশফিকুর রহমান পলাশ হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলে জানা গেছে। সে বরমীর পাঠানটেক গ্রামের মহিদুর রহমানের ছেলে।
নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, গৃহবধু সাবিনার তিনজন কন্যা সন্তান রয়েছে। আাগামী মাসে তার চতুর্থ সন্তান ডেলিভারীর সময় দেওয়া ছিল। রবিবার দুপুরে গৃহবধু সাবিনা আক্তার তার শারীরিক পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ সুস্থ্য অবস্থায় বরমী বাজারের ওই হাসপাতালে যান। এরই এক পর্যায়ে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান হাসপাতালের চিকিৎসক মুশফিকুর রহমান পলাশ। সেখানেই বিশেষজ্ঞ সার্জন, এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ছাড়াই নিজেই হাসপাতালের নার্সদের নিয়ে অপারেশন শুরু করেন। এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পরেই নার্সরা এসে জানায় গৃহবধুর অবস্থা খারাপ তাকে জরুরি ভাবে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে বলে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা যায় গৃহবধু মৃত।
নিহত গৃহবধুর স্বামী আব্দুস সাহিদের ভাষ্য, তাকে অপারেশনের কথা বলায় তিনি পরিবারে অন্যান্য স্বজনদের সাথে পরামর্শের জন্য বাড়িতে যান। এসেই দেখেন তার স্ত্রীর এই অবস্থা। অপারেশনের জন্য তাদের কারও কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। চিকিৎসকের ভুলে তিনি হারিয়েছেন তার স্ত্রী, তার সন্তানরা হারিয়েছেন তাদের মাকে। তিনি এর বিচার চান, এভাবে যেন আর কারও প্রাণ না যায় এ বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
গৃহবধুর সাথে থাকা তার ভাতিজি ফারিহা আক্তার জানান, সে শারীরিক পরীক্ষার কক্ষে তার চাচীর সাথে ছিলেন, তার চাচা গিয়েছিলেন বাড়িতে। এমন সময় তাকে সেখান থেকে বের করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি বার বার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও কাজ হয়নি। বারবার বলেছি চাচা আসলে চাচীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, চাচিও যেতে চাচ্ছিল না তারা জোর করেই চাচিকে নিয়ে গেছে।
এবিষয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি, গত রাত থেকেই তারা হাসপাতাল তালাবদ্ধ করে পালিয়ে গেছেন।
অভিযুক্ত চিকিৎসক মুশফিকুর রহমান পলাশের মোবাইলে কল দিলে নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, চিকিৎসকের ভুলে যদি রোগি মারা গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যেই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বিষয়টির খোঁজ নেওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (ওসি) জাবেদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খবর পেয়ে সকালে গৃহবধুর বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন