শুক্রবার, ২২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

শিশুসাহিত্যে নজরুল

আফতাব চৌধুরী

শিশুসাহিত্যে নজরুল

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার বিদ্রোহী কবি, তেমনি প্রেম ও প্রকৃতির কবি। তবে জাতীয় কবি অভিধার চেয়েও বড় যা কিছু গৌরবের তা হচ্ছে, বিশ্বের দেশে দেশে শোষিত নির্যাতিত মানুষের মধ্যে শোষণ-নিপীড়ন বঞ্চনা আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে আত্মজাগরণ এবং অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা। আর এটাই হচ্ছে বিশ্বময় নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় কীর্তি ও পরিচয়।

বৈচিত্র্যময় এক বিরল প্রতিভার অধিকারী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তার পদচারণা। বীর রস, করুণ রস, হাস্যরস সবই ছিল তার সৃষ্টির ভান্ডারে। তাছাড়া শিশুসাহিত্যেও নজরুলের বিশেষ অবদান রয়েছে।

শিশুসাহিত্য বলতে পাঁচ বছরের অধিক ও এগারো বছরের অনধিক বয়সী বালক-বালিকাদের জন্য রচিত যে-কোনো সাহিত্য পদবাচ্য রচনাকেই বোঝায়। বয়সের এ মাপকাঠি বালক-বালিকাদের গড়পড়তা সানসিক উৎকর্ষ বিচারের ওপর সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের জন্য রচিত রচনাকেও শিশুসাহিত্য অনেকে বলে থাকেন।

শিশু মন অতিমাত্রায় খেয়ালি, স্বপ্নময়, কল্পনাপ্রবণ। শিশু মনের সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্মবোধ না জমলে, শিশুভাবে ভাবিত না-হলে প্রকৃত শিশুসাহিত্য রচনা অসম্ভব। তবে শিশুসাহিত্য রচনায় নজরুলের অসাধারণ সাফল্য অনস্বীকার্য। উৎকর্ষের বিচারে  নজরুলের শিশুসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের এক দুর্লভ সম্পদ। শিশুসাহিত্যের কোনো কোনো জায়গায় তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

ঝিঙেফুল, খুকী ও কাঠবিড়ালী, মা, খাদু-দাদু, খোকার বুদ্ধি, খোকার গল্প বলা, চিঠি, লিচু চোর, ঠ্যাংফুলী ও পিলে-পটকা, হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন, প্রভাতী ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য ছোটদের কবিতা। প্রভাতী কবিতায় প্রভাতের বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকরভাবে, আর উৎসবমুখর ঝরনাধারার মতো কবিতারটির গতিও অবারিত।

‘ভোর হল দোর খোলো খুকুমণি ওঠরে!

ঐ ডাকে যুঁই শাকে ফুল-খুকী ছোটরে।’

এই প্রভাতী কবিতাটি ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। ঝিঙেফুল কবিতাটি একটি মিষ্টি কবিতা।

‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল

সবুজপাতার দেশে ফিরোজিয়া

ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল!

‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতায় খুকুর উক্তির মধ্যে শিশু হৃদয়ের কল্পনাবিলাস ও জীবজন্তুর জীবন সম্পর্কে তার অসীম কৌতূহল ও আত্মীয়তাবোধ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও ছন্দে শিশুসুলভ চপলতা লক্ষণীয়।

‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও?

বাতাবি-নেবু? লাউ?

বেড়াল-বাচ্চা কুকুর ছানা? তাও?’

ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থে মোট ১৩টি কবিতা রয়েছে যা পুরোপুরি শিশুদের উপযোগী। নজরুলের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চয়ন’ যা শিশুসাহিত্যের অনন্য অবদান। এতে আছে ২৬টি কবিতা ও একটি নাটক আছে। তার মধ্যে প্রার্থনা, মা এসেছে, জননী জাগো, কোথায় ছিলাম আমি, মোরা দুই সহোদর ভাই, প্রজাপতি, বগ দেখেছো? আগুনের ফুলকি ছোটে ও মায়া মুকুর উল্লেখযোগ্য।

প্রজাপতি গানটিতে নজরুল শিশুর  কাছে প্রজাপতির বিচিত্র সুন্দর রূপ ও তার মুক্তজীবনের আকর্ষণকে সার্থকভাবে রূপায়িত করেছেন।

‘প্রজাপতি!

তুমি নিয়ে যাও সাথী করে তোমার সাথে।

তুমি হাওয়ায় নেচে নেচে যাও,

আজ তোমার মত মোরে আনন্দ দাও।’

এছাড়াও, বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-পুতুলের বিয়ে, ঘুম জাগানো পাখি, ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি ইত্যাদি এবং কাব্যগ্রন্থের মধ্যে শেষ সওগাত, ঝড় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, যা চিরকাল পাঠকের হৃদয় হরণ করেছে এবং করবে। এছাড়াও ছড়া, কবিতা-গানে তার রয়েছে অসামান্য অবদান।

শিশুসাহিত্যে নজরুলের অবদান অপরিমিত, তিনি শিশুসাহিত্যে অদ্বিতীয় এবং কালজয়ী। তাই চিরকাল শিশুরা ভক্তিভরা নয়নেই তাকে স্মরণ করবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর