মনিরুল ইসলাম স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এক বছর পর তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করবেন। তার মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল। তিনি তিন কন্যা সন্তানের বাবা। বড় দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ের বিয়ে আগামী শুক্রবার। ছোট মেয়েকে তিনি একটু বেশি ভালোবাসেন। আজ মনিরুল ইসলাম সাহেব শহরে যাচ্ছেন ছোট মেয়ের জন্য সোনার গয়না কিনতে। তিনি শহরে যাওয়ার উদ্দেশে একটি বাসে উঠলেন।
বাসে তার পাশের সিটে একটি ফুটফুটে শিশু বসে আছে। তার মায়ের সাথে। শিশুটির পরনে লাল ফ্রক। শিশুটির বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ বছর হবে। মনিরুল ইসলাম ছোট শিশু দেখলে তার মেয়েদের ছোটবেলার কথা মনে হয়। ছোট মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে ঘরটি ফাঁকা হয়ে যাবে। তার বুকের মধ্যে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস বের হয়ে এলো। পাশের সিটে বসা শিশুটি বারবার তাকে দেখছে।
মনিরুল ইসলাম মেয়েটির তাকানো দেখে চুপ থাকতে পারলেন না। আগ্রহ নিয়ে বললেন, তোমার নাম কি?মেয়েটি দ্রুত বলল, ফুলরেনু, মা আমাকে রেনু বলে ডাকেন। তুমি কোথায় যাও দাদু?
দাদু শব্দটা শোনার সাথে সাথে মনিরুল ইসলাম বললেন, আমি সামনের শহরে নামব। তবে বলো তো, আমাকে দাদু বলছ কেন? আমি কি তোমার দাদুর মতো দেখতে?
আমি আসলে তোমার মতো মানুষদের দেখলে তাদের দাদু বলে ডাকি।
মনিরুল ইসলাম রেনুর কথা শুনে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ও আচ্ছা। তুমি তো তাহলে দাদু ভক্ত। এবার বলো কোথায় যাচ্ছ?
দাদু, মামা বাড়ি যাচ্ছি।
মামা বাড়িতে যাওয়ার আনন্দই তো আলাদা। তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমার না।
রেনু আর মরিরুল ইসলাম অনবরত গল্প করে যাচ্ছে। এর মধ্যে মনিরুল ইসলামের চোখে পানি চলে এলো। তার ছোট মেয়েটাও এভাবে সারাক্ষণ গল্প করে। মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে কাকে নিয়ে বাঁচবেন তিনি। মনটা খারাপ হলো। বাসটি খুব বেশি দ্রুত চলছে।
মনিরুল ইসলাম স্বাভাবিক হয়ে বললেন, রেনু তোমার বাবা কোথায়?
রেনু বাসের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তো আকাশে চলে গেছেন!
মনিরুল সাহেবের খুব মায়া নিয়ে রেনুর মাকে জিজ্ঞেস করলেন, মা তোমার স্বামী কোথায়?
তিনি বেঁচে নেই। এক বছর হলো দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
এখন কোথায় থাকো তোমরা?
শ্বশুরবাড়ির কেউ পছন্দ করে না। বোঝা মনে করে। এখন বাবার বাড়ি থাকার জন্য যাচ্ছি।
কি বল মা, মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তো তোমার বেঁচে থাকতে হবে। কাজ করো সবাই পছন্দ করবে। সব দুঃখ দূর হবে।
কি কাজ করব বাবা?
তুমি আমাকে বাবা বললে!
হঠাৎ করে তাদের বাসটিকে উল্টো দিকে দিয়ে আসা একটি ট্রাক সজোরে ধাক্কা দিল। মনিরুল সাহেব এবং রেনু সামান্য আহত হলেন। কিন্তু রেনুর মায়ের সারা শরীর ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। তার আঘাতের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। রেনু শক্ত করে মনিরুল সাহেবের হাত ধরে আছে। অচেনা মানুষ আজ এই বিপদের দিনে রেনুর খুব আপন হয়ে গেল। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো রেনুর মাকে।
আত্মীয়-স্বজন সবাইকে ফোন করে আনা হলো। কিন্তু কেউ রেনুর মায়ের বিশাল ব্যয় ভার বহন করতে চাইল না। এক মাস পর মনিরুল সাহেবের চেষ্টায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল রেনুর মা। রেনুর মায়ের হাত ধরে মনিরুল সাহেব বললেন, ‘মা আমার বাড়িতে চল। তোমার আর রেনুর যতেœর কোন ত্রুটি হবে না।’
মনিরুল ইসলামের কথা শুনে রেনু বলল, ‘মা আমাদের তো কেউ দেখতে পারে না। আবারও প্রমাণ পেলাম। বাসের ভেতর দাদুর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে দাদু অনেক ভালো মানুষ। মানবিক মানুষ। দাদুর বাসা চলো। আমরা ভালো থাকতে পারব।’
রেনুর কথা শুনে তার মা রাজি হয়ে গেলেন। মনিরুল ইসলাম রেনু আর তার মাকে নিয়ে বাসায় গেলেন। কয়েক দিন পর রেনুকে স্কুলে ভর্তি করা দেওয়া হলো।