শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সিন্দুকের চাবি

ইকবাল খন্দকার

সিন্দুকের চাবি

নাদিমের দাদার একটা সিন্দুক আছে। লোহার সিন্দুক। নাদিমের বাবা আর কাকার বিশ্বাস, সিন্দুকের ভিতর ভরি ভরি সোনা আছে। তাদের মনে এমন বিশ্বাস তৈরি হয়েছে সিন্দুকের চাবির ব্যাপারে দাদার সতর্কতা দেখে। ভীষণ সতর্ক তিনি। কাউকে চাবি ছুঁয়েও দেখতে দেন না। এক দিন নাদিম দাদাকে প্রশ্ন করে, নিজের ছেলেদের হাতে সিন্দুকের চাবি তুলে দিতে সমস্যা কোথায়। দাদা কিছু বলেন না। তিনি নাদিমকে নিয়ে চলে যান পুকুরপাড়ে। বলেন, এ পুকুরটা কাটিয়েছিলেন আমার বাবা। নানা জাতের মাছও ছেড়েছিলেন। আমাদের তখন মাছ কিনতে হতো না। নিজেদের খাওয়াও চলতা বিক্রিও করতে পারতাম। আমাদের তখন অনেক হাঁস ছিল। ওরা আমাদের সঙ্গে সাঁতার কাটত, খেলত।

দাদা অল্পক্ষণের জন্য থামেন। তারপর বলেন, তুই জানতে চেয়েছিলি তোর বাবা আর কাকার হাতে সিন্দুকের চাবি বা এর ভিতরে যে ধন-সম্পদ আছে, সেগুলো তুলে দিতে সমস্যা কোথায়। আছে সমস্যা। আমি তোর বাবা আর কাকাকে বহুবার অনুরোধ করেছিলাম, পুকুরটার যাতে যত্ন করে। যাতে এটাকে নোংরা হতে না দেয়। কিন্তু তারা আমার অনুরোধ রাখেনি। যদি রাখত তাহলে পুকুরটার এ অবস্থা হতো না। এখনো মাছ চাষ করা যেত, হাঁস পোষা যেত।

নাদিম পুকুরটা ভালো করে দেখে। তার মনে হয়, এটা যেন পুকুর নয়। বিশাল একটা ডাস্টবিন। দাদা বলেন, তুই হয়তো ভাবছিস, সিন্দুকের চাবির সঙ্গে এ পুকুরের সম্পর্ক কী। আছে, সম্পর্ক আছে। তোর বাবা আর কাকা পরিশ্রম করতে চায় না। তারা চায় জমানো টাকা। তাই তাদের চোখ পড়েছে আমার সিন্দুকের ওপর। কিন্তু কোনো লাভ নেই। যারা নিজের দাদার স্মৃতিবিজড়িত সম্পদের যত্ন নেয় না, সেই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে রোজগার করে না, সিন্দুকে জমানো টাকার আশায় থাকে, তাদের আশা কোনো দিনই পূরণ হবে না।

দাদা বাড়ির দিকে হাঁটা দেন। নাদিমও হাঁটে তার পাশাপাশি। হাঁটতে হাঁটতেই জানায়, সিন্দুকের চাবিটা সে এক দিনের জন্য চায়। তার কথা শুনে চমকে ওঠেন দাদা। আর পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কোনোভাবেই তিনি চাবি দেবেন না। এবার তার হাত চেপে ধরে নাদিম। সবিনয়ে বলে, আমার অনুরোধটা রাখেন দাদা। আমি কথা দিচ্ছি, চাবি নিলেও সিন্দুক খোলার কোনোরকম চেষ্টা করব না। চাবিটা আমি নেব অন্য একটা কারণে। দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না কারণটা কী।

দাদা নীরব থাকেন। পরদিন সকালে দাদা তার হাতে তুলে দেন সিন্দুকের চাবিটা। নাদিম দাদাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মাঝ উঠানে যেতেই সে সামনে পড়ে বাবা আর কাকার। তারা তাকে বলেন চাবিটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু সে দেয় না। নাদিম চাবি নিয়ে চলে যায় পুকুরপাড়ে। বাবা আর কাকাও যান তার পেছন পেছন। হঠাৎ নাদিম চাবিটা ছুড়ে ফেলে দেয় পুকুরে। বাবা আর কাকা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন মাটিতে। নাদিম বলে, সিন্দুক খুলতে হলে চাবিটা লাগবেই। অতএব...

নাদিম আর দাঁড়ায় না। চলে যায় নিজের কাজে। এদিকে বাবা আর কাকা লোকজন নিয়ে নেমে পড়েন পুকুরে। প্রথমে তারা ময়লা-আবর্জনা সরান। তারপর বড় বড় বালতি ভরে তুলতে থাকেন পচা কাদা। কিন্তু পাওয়া যায় না চাবিটা। বাবা আর কাকা সিদ্ধান্ত নেন, পানি সেচে ফেলবেন। স্যালো মেশিন লাগানো হয়। তুলে ফেলা হয় আলকাতরা রঙের সব পানি। এবার বাবা আর কাকা শুরু করেন নতুন করে চাবি খোঁজা। অল্পক্ষণের মধ্যেই চাবিটা পেয়ে যান তারা। আর চিৎকার করে ওঠেন খুশিতে- পেয়ে গেছি!

চাবি নিয়ে বাবা আর কাকা পাড়ে উঠতেই দেখেন দাদা দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে আছে নাদিমও। বাবা আর কাকা কিছু বলার আগেই দাদা হাসিমুখে বলতে থাকেন- আমার দাদুভাইয়ের মাথায় এত বুদ্ধি, জানা ছিল না। তোমাদের দিয়ে কী সুন্দর করে সে পুকুরটা সাফ করিয়ে নিল। এখন পরিষ্কার পানি দিয়ে পুকুরটা ভরে মাছ ছেড়ে দিলেই হবে। দাদা জড়িয়ে ধরেন নাদিমকে। বাবা দাদাকে চাবিটা ফিরিয়ে দিতে চান। কিন্তু তিনি নেন না। বলেন, এ চাবিটা আজ থেকে তোমাদের। তবে আবার কোনোদিন যদি পুকুরটার অযত্ন কর, তাহলে কিন্তু ফিরিয়ে নেব।

এক মাস পর। দাদা বসে আছেন পুকুরপাড়ে। মুগ্ধ চোখে সাঁতার কাটা দেখছেন তিনি। টলটলে পানিতে সাঁতার কাটছে নাদিম ও তার বন্ধুরা।  আর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটছে একদল হাঁস। দেখতে দেখতে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন দাদা। তিনি ফিরে যান তার দুরন্ত কৈশোরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর