রাজন প্রতি বছর ক্লাসে প্রথম হয়।
মা-বাবার একমাত্র ছেলে। লেখাপড়ায় ভালো। কোনো দিনও পড়তে বলতে হয় না। সকাল-সন্ধ্যা ঠিক সময়ে পড়তে বসে। হোম টিচার খুব ভালোবাসে রাজনকে।
একদিন রাজনের মাকে বলে,
অনেক ছেলে পড়িয়েছি, কেউ অংকে কাঁচা, নয় ইংরেজিতে। বারবার শিখাতে হয়। মাথা গরম হয়, যদি না শিখতে পারে। রাজন কিন্তু তা নয়। সবার থেকে আলাদা। সে একদিন বড় হবে।
আশীর্বাদ করবেন। মায়ের উত্তর।
রাজন দুষ্টু নয়, চঞ্চলও নয়, শান্ত, নম্র, বিনয়ী। ক্লাসের প্রতিটি স্যার প্রচ- ভালোবাসে, স্নেহ করে। তবে সে খেলতে চায় না। কোনো খেলা তার পছন্দ নয়। সে শুধু পড়বে। পাঠ বই ছাড়াও শিশুতোষ গল্প, ছড়ার বই পড়ে।
রাজনের বৃষ্টি ভালো লাগে। বৃষ্টিতে কোলাহল নেই। রাস্তায় ধুলো উড়ে না। দখিনের জানালায় দাঁড়িয়ে মেঘবৃষ্টি দেখা যায়। বৃষ্টিকণা ধরে মনে মনে বলে,
কি ঠান্ডা, শীতল। আচ্ছা বৃষ্টি কীভাবে হয়? ওরা পড়ে কেন? আকাশে থাকতে পারে না।
তখনই কালো মেঘ গর্জন করে, গুড়ুম গুড়ুম। মেঘের গর্জন রাজনের ভীষণ পছন্দ। সে মেঘের গর্জন ছুঁতে চায়। গুড়ুম গুড়ুম গর্জনকে কাছে ডাকে, আয় আয়। আসে না। মেঘে শুধু ডাকে।
আজ বৃষ্টি থামে না।
পড়ছে শুধু পড়ছে। সঙ্গে ঠান্ডাও খেলছে। মা মোটা কাপড়ের শার্ট পরিয়ে দেয়। রাজন বলে,
মা, বৃষ্টি থামছে না কেন?
থামবে রাজন। বৃষ্টি পড়া শেষ হলে নিশ্চয়ই থামবে।
মা বৃষ্টি পড়ে কেন?
আকাশে মেঘ জমলে, যখন মেঘ ধরে রাখতে পারে না, তখনই বৃষ্টি পড়ে। চল খেয়ে নে। আজ রাত জেগে পড়ার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পর।
মায়ের সে অবাধ্য হয় না। খেয়ে বিছানায় শুতে যায়। রাত বাড়ে। বৃষ্টি পড়ে, ঝুপঝুপ। সঙ্গে মেঘের ছোট-বড় ডাক। রাজন ঘুমে।
রাজনকে জলদেবতা বলে, পাতালপুরে যাবে? কাঁধে ওঠ।
যাবো। ওমা, তুমি এত বড়ো কীভাবে কাঁধে উঠব? একটু নিচু হও, তবে উঠব। তার আগে বল,
ওটা কোথায়? ওখানে কী আছে?
সাগর নিচে। ওখানে রাজপ্রাসাদ আছে, রাজারানী, রাজকন্যা আছে। খুব সুন্দর। ওরা ভীষণ ভালো।
অনেক সৈন্য আছে। সুন্দর রাজপ্রাসাদ। চোখ জুড়ে যায়। তোমার মন ভরে যাবে।
আমার সঙ্গে রাজকন্যা কথা বলবে?
নিশ্চয়ই বলবে। যারা লেখাপড়ায় ভালো ওদের সে বন্ধু হয়।
সত্যি?
সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি। চল আর দেরি নয়। এবার কাঁধে ওঠ।
রাজন দেরি করে না। কৌতূহলে মন ভরে গেছে। পাতালপুরীর রাজকন্যা দেখবে। কী মজা! জলদেবতার কাঁধে চেপে বসে।
রাজন বসার সঙ্গেই জলদেবতা জলে ডুব দেয়।
ধীরেধীরে জলের গভীরে নামতে শুরু করে জলদেবতা। জলদেবতা বলে,
রাজন ভয় পেও না। আমরা ঠিক সময়ে পাতালপুরী পৌঁছে যাব।
আমি জলে ভিজে যাব না?
না না ভিজবে না। যারা পাতালপুরীর রাজকন্যাকে দেখতে যায়, ওরা ভিজে না। তা ছাড়া তুমি তো পাতালপুরী জয় করতে যাচ্ছ। তুমি পাতাল বিজয় পুত্র।
ও তাই!
ওরা এক সময় পাতালপুরীর রাজবাড়িতে পৌঁছে। চারদিকে সব কিছু সোনার রঙে চিকচিক করছে। বড় গেইট। গেইটে গোঁফে ঢাকা সিপাহী। হাতে তলোয়ার। রাজন জলদেবতার সঙ্গে রাজবাড়ি ঢুকছে। কেউ মানা করে না। সম্মান করছে সবাই।
অনেক ঘর পেরিয়ে একটি ঝকঝকে সুন্দর ঘরের সামনে দাঁড়ায়। দরজায় দুজন সিপাই। জলদেবতা বলে,
রাজকন্যার সঙ্গে রাজনবাবু দেখা করবে।
সিপাই দরজা খুলে দেয়।
দরজা খুলতেই দেখে একটি ঝকঝকে সোনার সিংহাসনে রাজকন্যা বসে। পরনে রাজকীয় পোশাক। মাথায় তাজ। রাজকন্যার পেছনে দুজন মেয়ে ময়ূরপাখা দিয়ে বাতাস করছে। রাজনকে দেখে রাজকন্যা ডাকে,
এসো রাজন।
রাজন অবাক। ভাবে, রাজকন্যা আমার নাম জানে? জলদেবতাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা রাজকন্যা আমার নাম জানলো কী করে?
আমি বলেছি।
রাজকন্যা আবারও ডাকে, রাজন এসো। লজ্জা পাচ্ছো কেন? তুমি তো পাতাল বিজয় করতে এসেছো। সবাই এটা পারে না। এখানে আসা কঠিন। তুমি পেরেছো। তোমাকে ধন্যবাদ।
রাজন পা বাড়ায়। মুখে হাসি।
তখনই মা ডাকে,
রাজন ওঠ বাবা। কখন সকাল হয়েছে। তুই তো দেরি করিস না ঘুম থেকে উঠতে। ওঠ বাবা ওঠ।
রাজনের রাগ হয়। বলে, আমি যাচ্ছি পাতালপুরী রাজকন্যার সঙ্গে কথা বলতে। আর মা, তুমি ডাকছো।
রাজনের কপালে মায়ের হাত। মা আবারও ডাকে ওঠ রাজন।
রাজন বলে, মা বিরক্ত কর না। আমি এখন পাতালপুরী রাজকন্যার সামনে। ওর সঙ্গে কথা বলবো।
মা হাঃ হাঃ শব্দ করে হাসে। প্রচন্ড হাসির শব্দে রাজন চোখ খোলে। জানালার পর্দার ফাঁকে সূর্যের আলো রাজনের চোখে খেলে। চোখের সামনে মায়ের মুখ।
মা হাসছে।
রাজন বলে, মা আমি কোথায়?
বিছানায়।
আমি তো এতক্ষণ পাতালপুরীর রাজকন্যার সামনে ছিলাম।
না বাবা তুই স্বপ্ন দেখছিলি।
রাজন মায়ের কথা শুনে মনে মনে বলে,
ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা!